আলাঁ বাদিউ এর চোখে ইতিহাসের পুনর্জন্ম:
দাঙ্গা আর অভ্যুত্থানের কাল

আমরা একটা বিক্ষুব্ধ সময়ে বাস করছি- আলাঁ বাদিউ এর কথাটার সাথে দ্বিমত করার সুযোগ কম।
বিক্ষোভ দানা বাঁধছে আরবে, আফ্রিকায়, এশিয়ায়, ইউরোপে, এমনকি খোদ আমেরিকায়। যদিও বাদিউ কথাটা বলেছেন ২০১২ সালে, কিন্তু বিক্ষোভ আর দাঙ্গা এখনো গড়ে উঠছে পৃথিবীর কোণায় কোণায়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল নিওলিবারেলিস্টদের; তাদের তাহলে বিকল্প হয় না!
এই নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর খুব বেশিদিন তোলা হয়নি তাদের। আবার অশান্ত হয়ে উঠতে শুরু করল পৃথিবী। বিশেষ কর ২০১১ সাল একটা মাইলস্টোন।
দেশে দেশে গণঅভ্যুত্থান, বিক্ষোভ; কি ইউরোপ, কি আফ্রিকা, কি মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি এশিয়ায়! কায়রো, মাদ্রিদ, এথেন্স ও নিউইয়র্কের 'অকুপাই' মুভমেন্টে বামপন্থা আবার যেন সাহস পেল। ভাবিয়ে তুলল জোডি ডিন, স্লাভোই জিজেক, ও আলাঁ বাদিউ'র মতো চিন্তাবিদদের। তারা গভীর মনযোগ দিয়ে পড়েছেন সেই বিক্ষোভ-বিদ্রোহগুলো, বোঝার চেষ্টা করেছেন তাদের রসায়ন।
'The Rebirth of History- Times of Riots and Uprisings' বইটির শুরুতেই আলাঁ বাদিউ লিখেছেন- "হচ্ছেটা কি আসলে? উত্তেজনা আর বেদনা নিয়ে কিসের সাক্ষী থাকছি আমরা?
একটা ক্লান্ত দুনিয়ার টিকে থাকার সংগ্রাম? আশাজাগানিয়া বৈশ্বিক সংকট আর তার বেদনাদায়ক বিস্তার? পৃথিবীর শেষ? একটা নতুন পৃথিবীর সূচনা?
শতাব্দী শুরু হতে না হতেই কি হচ্ছে আমাদের সাথে? যা হচ্ছে, প্রচলিত ডিকশনারিতে তার কি কোন নাম আছে?
তবে, এই বই শুধুমাত্র সেই ঘটনাগুলোর বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। কেবল বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা, বা মূল্যায়ন দাঁড় করানোর রাস্তাতেও হাঁটেনি।
বরং এক ধরনের দার্শনিক-রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে।
বিচ্ছিন্ন ও ঘটনাগুলোকে পাশাপাশি রেখে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে তাদের সম্পর্কগুলো। বাদিউ নিশ্চিত ছিলেন, এখনো সুসংহত হয়ে উঠেনি কোন আন্দোলন। তার মতে- এখনো পর্যন্ত এই আন্দোলনগুলো একচোখা, বিচ্ছিন্ন এবং নেতৃত্ব কোন শক্তিশালী সংগঠনের অভাবে দুর্বল।
যে কোন ধরণের বিক্ষোভই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেগুলো যথেষ্ট নয়। বিক্ষোভের সাথে অবশ্যই যুক্ত থাকতে হয় মহান, যুগান্তকারী কোন আইডিয়া। বাদিউ মনে করেন, যদি এই বিক্ষোভগুলো সত্যিই ইতিহাসের পুনর্জাগরণ ঘটাতে চায়, তাহলে কেবল জ্বালাও-পোড়াও ঘটালে হবে না, তাকে হাজির করতে হবে নতুন কোন আইডিয়া।
বিক্ষোভ, বাদিউ এর মতে, তিন প্রকার হতে পারে।
- এক, তাৎক্ষনিক বিক্ষোভ (Immediate riot)
- দুই, সুপ্ত বিদ্রোহ (Latent riot)
- তিন, ঐতিহাসিক বিক্ষোভ (Historical riot)
'তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ' হয় আবেগতাড়িত; অন্যায়ের বিরুদ্ধে হঠাত বিস্ফোরণ। অনেক কিছু চিন্তা না করেই শুরু হয়, রাস্তায় রাস্তায় সহিংসতা ছড়ায়। ২০১১ সালের আগস্টে লন্ডনে ঘটে যাওয়া দাঙ্গা, বাদিউ এর মতে এর উদাহরণ। এই সব আন্দোলনের প্রতি সহানভুতি জাগলেও এখানে লুটতরাজের মত নানান অঘটনও ঘটে।
'সুপ্ত বিদ্রোহ' তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত গণপ্রতিবাদ। জনগণের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ক্ষোভ ও হতাশা, উপযুক্ত পরিস্থিতি পেলে সহিংস দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে। বেকারত্ব, দারিদ্র্য, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বা বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ দীর্ঘদিন ধরে জমে latent riot হিসেবে প্রকাশিত হতে পারে। কোনো বিশেষ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এই সুপ্ত ক্ষোভ তাৎক্ষণিক বা ঐতিহাসিক দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে।
আর 'ঐতিহাসিক বিক্ষোভ'র ব্যপ্তি হয় অনেক ছড়ানো, উদ্দীপনা থাকে প্রচণ্ড, সংকল্প হয় দৃঢ়; কিন্তু এর দ্বারা কোন নতুন শাসনব্যবস্থার জন্ম হয় না। বাদিউ বলেন, ঐতিহাসিক দাঙ্গা কেবল পরিবর্তনের শুরুর ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু সেটাই রাজনীতি হয়ে ওঠে না। কিন্তু আবার, এই সব বিক্ষোভ থেকেই জন্ম হতে পারে রাজনৈতিক গণআন্দোলনের।
বিক্ষোভের এই সব ব্যাখ্যা আমাদের একটা দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। এত সব আন্দোলন, বিশৃঙ্খলা বা গণআন্দোলন- কোনটিকে আসলে কিভাবে দেখা বা বোঝা উচিত! [Review: Alain Badiou, The Rebirth of History: Times of Riots and Uprisings, trans. Gregory Elliott (London: Verso, [2011] 2012). 120 pages, Cayley Sorochan (McGill University)]।
আদর্শিক ভিত্তি ছাড়া বিক্ষোভগুলো যত আবেগপ্রবণ বা দৃশ্যত যত শক্তিশালীই হোক না কেন, সেগুলো একটা সময় 'নেতিবাচক' মনে হতে পারে। বাদিউ এর মতে, জনগণ তখন কেবল জানে, সে কি চায় না; কি চায়, তা সে জানে না। যেমন, মিশরের মানুষ হোসনি মুবারক'কে চায়নি; কিন্তু তার বদলে কি চায়, সেই লক্ষ্যটি স্পষ্ট করতে পারেনি।
বাদিউ মনে করেন, বিক্ষোভ ও গণবিপ্লবের চরিত্র যেমনি হোক না কেন, এগুলো 'ইতিহাসের ফেরার' ইঙ্গিত দেয়। জনগণ আবার নিজেদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে শুরু করার দিকনির্দেশনা পায়। বিক্ষোভ কেবল ক্ষোভের প্রকাশই নয়; সংগঠিত হলে এটি নতুন রাজনৈতিক পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
কিন্তু তার আগে চাই রাজনৈতিক সংগঠন ও আদর্শগত নেতৃত্ব।