ছক কাটা সব সৃষ্টির বিপদের মিথ

Asad_USA
প্রশ্ন এখন আর এটা নয় যে, যন্ত্রবুদ্ধি শিল্পীর ভূমিকায় নামবে কি না। নেমে সে পড়েছেই।

যন্ত্রবুদ্ধি প্রায় প্রতিদিনই আনছে নতুন সব চমক।

প্রবন্ধ লিখে দিচ্ছে, গল্প নিয়ে কথা বলছে, ওয়েব সাইট বানিয়ে দিচ্ছে, ছবি এঁকে দিচ্ছে এমনকি চমৎকার সব ভিডিও বানিয়ে দিচ্ছে। আতংক ছড়িয়ে পড়ছে সৃষ্টিশীল জগতে।

শিল্পীদের দিন কি তাহলে শেষ?

বড় বড় কর্পোরেশন কি বাজারের চাহিদামত বানিয়ে যাবে একের পর এক সিনেমা, লিখে যাবে তুমুল কাটতির বই, কিংবা এঁকে যাবে মাস্টারপিস? কাজ হারানোর ভয়ে কাঁপছে বাণিজ্যিক শিল্পের জগত।

প্রশ্ন এখন আর এটা নয় যে, যন্ত্রবুদ্ধি শিল্পীর ভূমিকায় নামবে কি না। নেমে সে পড়েছেই।

এখন প্রশ্ন হল- এই নতুন সময়ে তাহলে শিল্পের ভবিষ্যৎ কি?



যন্ত্রবুদ্ধি কাজ করে ফর্ম নিয়ে, আবেগ দিয়ে নয়

করোটির ভিতর সেই ধূসর জগতের রহস্যময় রসায়নের তথ্যভাণ্ডার এখন পর্যন্ত সম্ভব করার কথা ভাবা যায় না।

উনবিংশ শতাব্দীতে অস্কার ওয়াইল্ডরা বলছিলেন 'শিল্পের জন্য শিল্প' এর কথা।

সেই সময় এই কথা শুনে অনেকের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল। এতদিন তো জানা ছিল, শিল্প মাত্রই সমাজের নীতি নৈতিকতা নিয়ে কথা বলবে, সততার প্রচার করবে। জন রাস্কিন'দের সেই সব চিন্তার বদলে এল নতুন বক্তব্য- শিল্প হবে কেবলই সুন্দর; নীতি নৈতিকতার কোন ধার এ ধারবে না।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে মডার্নিস্টরা প্রথাবিরোধী কাজ করেছে ঠিকই, কিন্তু তাদেরও চিন্তা চেতনায় ছিল মানব জাতির প্রগতি আর সর্বজনীন সত্যের ধারনা। উত্তারুধুনিকরা এসে এখানে আবার একটা গণ্ডগোল লাগিয়ে দিল। বলল- গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বলে কিছু নেই।

এই যে শিল্পকে দেখার দর্শনের পরিবর্তন যুগে যুগে হয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে এসেছে নতুন নতুন শিল্পের ফর্ম। সেই ফর্ম ধারণ করার চেষ্টা করেছে সময়ের আবেগকে। এই যন্ত্রবুদ্ধির সময়ে পরিবর্তনের ধারনাটি একইভাবে প্রযোজ্য।

কিভাবে?

ধরা যাক, একজন তরুণ লেখক একটা প্রেমের গল্প লিখবে বলে ঠিক করেছে। এই গল্পের রশদ খুঁজে বেড়াচ্ছে সে নিজের স্মৃতিতে, বন্ধুদের আড্ডায়, পাশের সিটের যাত্রীর মুখে আর চেতনে বা অবচেতনে খবরের কাগজের পাতায়। বিচিত্র সব মানুষের বিচিত্র গল্পগুলো তার মাথার ভিতর ধোঁয়ার মত পাক খেতে খেতে হঠাত একটা আকার পেতে শুরু করে। যে আকার পেতে শুরু করেছে, তার সাথে মস্তিষ্ক তর্কে জড়ায়, হৃদয় অভিমানী হয়। অবশেষে কলম কি কি বোর্ডে গড়িয়ে আসে সেই আবছায়া জগতের আপাত মীমাংসা। একজন প্রেমিক আর প্রেমিকা শব্দ হয়ে ঘুরতে থাকে পাতা থেকে পাতায়।

এই যে এক লেখকের করোটির ভিতর এত ক্ষরণ, এমন অনেক লেখকের অভিজ্ঞতাগুলোকে এক করে যদি সাজিয়ে তোলা যায়, তাকেই তথ্যপ্রযুক্তির ভাষায় বলা যেতে পারে- তথ্যভাণ্ডার বা ডেটাবেইজ।

এখানে একটু কথার সংশোধন করে নেয়া যাক। করোটির ভিতর সেই ধূসর জগতের রহস্যময় রসায়নের তথ্যভাণ্ডার এখন পর্যন্ত সম্ভব করার কথা ভাবা যায় না। ভাবা যায়, তার যান্ত্রিক প্রকাশকে।

যেমন- চিত্রনাট্য কেমন হওয়া উচিত এই নিয়ে গাদা গাদা লেখা হয়ে আছে সিডফেল্ড, স্নাইডার বা জন ম্যাককি-সহ আরও অসংখ্যজনের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং এর কোর্স থাকায় লেখা হয়ে গেছে উপন্যাসের প্রকরণ, ছোট গল্পের চলন বা কবিতার নতুন বিন্যাস।

খেয়াল করে দেখুন- এগুলো সবই ফর্মের আলোচনা।

সিডফেল্ড যখন বলে থ্রি অ্যাক্টের কথা, জন ম্যাককি যখন বোঝায় ইন্সাইটিং ইন্সিডেন্টের গুরুত্ব- তখন আসলে তারা একটা চিত্রনাট্যের ফর্ম নিয়েই কথা বলছে। আর এই জিনিসগুলো অনায়াসে একটা তথ্যভাণ্ডারে রাখা সম্ভব। সেই তথ্যভাণ্ডার থেকে উদাহরণ টেনে টেনে নিজের গল্প বলার ধরণ আরও ঘষে মেজে নেয়া সম্ভব। যন্ত্রবুদ্ধি ঠিক এই কাজটাই করছে।

তার নিজের কিছু বলার নেই (অন্তত এই মূহুর্তে), আছে কেবল বলার ধরনের ধারণা।


সহশিল্পী এস, গোল বেঁধে গেলে হেস

আলাপ-গল্পে একটা সেশন কাটার পরে কি শিল্পী বা লেখকের মাথায় নতুন কোন দৃষ্টিকোণ উঁকি দেয় না?

একজন শিল্পী, একাকী থাকে না। তার একটা কমিউন থাকে; থাকে সহশিল্পী।

থাকতেই হয়, কেননা এমনি এমনি একা একা শিল্পসৃষ্টি সম্ভব না। না লেখক, না চিত্রশিল্পী, না ফিল্মমেকার- কারো পক্ষেই না।

যেমন, শিল্প সৃষ্টি করতে গেলেই যে কোন লেখকের বা শিল্পীর একটা নৈতিক অনুমোদন লাগে, নিজের কাছেই। এই অনুমোদন সে সংগ্রহ করে নানা উপায়ে। কখনো বন্ধুকে শিল্পকর্ম দেখিয়ে, কখনো মুরুব্বি শিল্পীকে শুনিয়ে, আর কখনোবা অন্য শিল্পীদের সাথে কথা বলে। যন্ত্রবুদ্ধি এসেছে সেই তালিকায় আরেকটি উপাদান হয়ে।

গল্পের আইডিয়া লিখে যন্ত্রবুদ্ধির সাথে চিন্তা ভাগ করে নিলে, সে নানা পরামর্শ দিতে থাকে। খেয়াল করুন আবার- পরামর্শগুলো সবই তথ্যভাণ্ডার থেকে টেনে নেয়া ফর্মের ধারণার উপর দাঁড়ানো। কিন্তু তাতে শিল্পীর ক্ষতি কি?

কিছু নয়।

আলাপ-গল্পে একটা সেশন কাটার পরে কি শিল্পী বা লেখকের মাথায় নতুন কোন দৃষ্টিকোণ উঁকি দেয় না?

একজন পেইন্টার তার ক্যানভাসের জন্য কোন নতুন আইডিয়া পায় না?

পেতে পারে, কিন্তু পাবেই এমন কোন কথা নেই।

সহশিল্পীদের সাথে প্রতি আড্ডাই কি আর ফল নিয়ে আসে না কি?

তাই বলে কি যন্ত্রবুদ্ধিকে সহশিল্পীর জায়গায় ফেলা হচ্ছে না কি? তা নয় একেবারেই।


বরং নিজেই লিখ নাকো একটি কবিতা… আলাপের সূত্র

একবিংশ শতাব্দীর আর্ট ফর্মকে দাঁড় করানো যাবে সম্পুর্ণ নতুন করে।

সমালোচকদের এক হাত নেয়ার জন্য বলেছিলেন জীবনানন্দ দাশ।

লেখা নিয়ে যে কথা বলতে আস, আগে লিখে দেখাও দেখি! এই যন্ত্রবুদ্ধির সময়ে তাহলে কি সবাই চাইলেই এখন কম্পিউটার বা মোবাইল খুলে হয়ে যেতে পারে শিল্পী! ব্যাপারটা অনেকটা টাইপরাইটারের যুগের মত। ১৮৭৪ সালে এই যন্ত্র আবিষ্কারের পরে রেমিংটন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ভাষাতে ছিল- "The writing machine of the age."

ভাবখানা যেন, টাইপরাইটার আছে বলেই হয়ে যাবে লেখাজোখা!

একজন লেখকের মাথার ভিতর সেই রহস্যময় রসায়ন নিয়ে টাইপরাইটারের সামনে বসাও যা, আজকের যন্ত্রবুদ্ধির সামনে বসাও তাই। আর যারা শিল্পী নন, মানে যাদের আগ্রহ শিল্পে নয়, তারা কি যন্ত্রবুদ্ধি দিয়ে লিখিয়ে নিতে পারবেন কোন গল্প?

যারা এই নিয়ে ঘাটাঘাঁটি করেছেন, তারা জানেন, পারবে না। বরঞ্চ আরও বেশি সুযোগ এসেছে শিল্পীদের সামনে। একবিংশ শতাব্দীর আর্ট ফর্মকে দাঁড় করানো যাবে সম্পুর্ণ নতুন করে।

যেমন, সিনেমা বানানোর অনেক উপাদান নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আপনি এখন নিশ্চিন্তে ভাবতে পারেন আপনার গল্প বলার ধরণ নিয়ে। টেকনিক্যাল সব কিছু আপনি করিয়ে নিন না যন্ত্রবুদ্ধি দিয়ে!

লাইফ অফ পাই বানাতে আর হয়ত বিশাল পানির ট্যাঙ্ক বানানোর দরকার নেই। সেই নিয়ে পরিচালক মাথা না ঘামিয়ে আরও বেশি মন দিতে পারেন, পাই এর চরিত্রের ধূসর দিক উন্মোচনে।

মিক্সড মিডিয়া নিয়ে যে শিল্পীরা কাজ করেন, তাদের ফটোশপ বা আফটার এফেক্টসের একশ লেয়ার নিয়ে আর কাজ করার দরকার হবে না। অনেক বেশি মন দিতে পারবেন কনসেপ্ট এর উপরে।



এখন কথা হতে পারে- যন্ত্রবুদ্ধি তো দিন দিন আরও আরও তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করে আরও বেশি শিক্ষিত হয়ে উঠছে। মানুষ কি আর পারবে আর তার সাথে? কল্পবিজ্ঞানের থিম হিসেবে নিঃসন্দেহে এটা খুবই দারুণ একটা ধারনা।

জুভাল নোয়াহ হারারি তার ইউটিউব ভিডিও Chat GPT Deliberately Deceives You! তে যখন বলেছিলেন, যন্ত্রবুদ্ধি এখন না কি মিথ্যা কথাও বলছে, সেটা সাড়া ফেলে দিয়েছিল সারা পৃথিবীতে। যদিও সেই ভিডিও'র বাইরে তার আর কোন বক্তব্য নেই। অন্য কোন যন্ত্রবুদ্ধি ব্যবহারকারীও এখন পর্যন্ত আর তেমন কথা বলেননি। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে এই কথা তোলা হয়নি।

তোলা হয়েছে, এখনো যৌক্তিকভাবে সেই সম্ভাবনা প্রকট নয় যে, যন্ত্র নিজের বুদ্ধিতে মানুষকে চ্যালেঞ্জ করতে যাচ্ছে। যদি করেও, সেটা ভবিষ্যৎ শিল্পীদের সমস্যা। তারা সেটা মোকাবিলা করবেন তাদের নিজেদের মত করে। আজকের যুগে যন্ত্রবুদ্ধি যতটুকু এগিয়েছে, তাকে কিভাবে হাতিয়ার বানিয়ে নতুন নতুন শিল্পকর্মে পৃথিবীকে তাক লাগানো যায়- সেটাই আজকের চ্যালেঞ্জ।

পড়ে দেখতে পারেন