জামাতের একাত্তরের বয়ান

image

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ কি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি? জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ কি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি?

এই দেশের রাজনীতিতে এই মূহুর্তের অন্যতম শক্তি জামায়াতে ইসলামী বলছে- না। সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিয়েছে।

দলটি কি যুদ্ধাপরাধী?

এর উত্তরেও সে বলছে- না; জামায়াত কেবল ভারতের সাহায্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে আপত্তি করেছিল।

১৯৭১ এ অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে থাকা দলটি এই অঞ্চলের বড় অংশের মানুষের মতামতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ইয়াহিয়া সরকারকে সমর্থন যুগিয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু কেন? এই নিয়ে তাদের ব্যাখ্যা জানার অন্যতম সূত্র তাদের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেই সময়ের আমির গোলাম আজম'র আত্মজীবনী।

গোলাম আজম তার আত্মজীবনী 'জীবনে যা দেখলাম' লিখতে শুরু করেন ২০০১ সালে; প্রকাশিত হতে থাকে 'দৈনিক সংগ্রাম' এ সাপ্তাহিক কিস্তিতে। নয় খণ্ডে প্রকাশিত গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে তিনি লিখেছে ১৯৬২ থেকে ১৯৭২ সালের স্মৃতি। এখানেই আছে ১৯৭১ সালের ঘটনাবলী নিয়ে তার অভিজ্ঞতা।

কিন্তু মুশকিল হল, এই বইতে জনাব গোলাম আজম'র অনেক বক্তব্যের সাথে সেই সময় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বা বিবৃতির মধ্যে বেশ কিছু অসংগতি দেখা যায়। তারচেয়েও বড় অসঙ্গতি ছিল তাদের নিজেদের বিশ্লেষণ আর জনগণের সামনে আনা কর্মসুচীর মধ্যে।

কিভাবে?

ছয়টি পয়েন্টে বিষয়টা দেখা যাক।

  • ১। অখণ্ড পাকিস্তানের প্রসঙ্গে জামায়াতও কি দোদুল্যমান ছিল?
  • ২। ২৫ মার্চ সম্পর্কে গোলাম আজম
  • ৩। টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ
  • ৪। একাত্তরে করণীয় নির্ধারণ
  • ৫। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী
  • ৬। ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাৎ

১। অখণ্ড পাকিস্তানের প্রসঙ্গে জামায়াতও কি দোদুল্যমান ছিল?

পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী সব সময়ই চেয়েছে, জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ইসলামিক রাষ্ট্রের চেতনা তুলে ধরতে। সেই জন্যই আওয়ামী লীগ যখন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের কথা বলেছে, জামায়াত সতর্ক হয়েছে। আওয়ামী লীগের ৬ দফার বিপরীতে এনেছিল ৮ দফা দাবি। এবং উদ্দেশ্য হিসেবেও বলেছিল-

  • "পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার পরিকল্পনাতেই ৬ দফা রচিত বলে ধারণা হয়। তাই এর বিকল্প হিসাবে পিডিএম (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট, জামায়াত নেতৃত্বে জোট) ৮ দফা দাবি পেশ করে, যাতে প্রাদেশিক সরকার পূর্ন স্বায়ত্বশাসন ভোগ করতে পারে (জীবনে যা দেখলাম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৩)।"

১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনও অবশ্য করেছে জামায়াত। এবং এরপর ৮ দফা বাদ দিয়ে ৬ দফা সমর্থনের জন্য শেখ মুজিব, দলটির সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। এরপর ১৯৭০ সালার নির্বাচনে জামায়াতের দাঁড়ানোর অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল 'বাতিল' শক্তির প্রধান আওয়ামী লীগের মোকাবিলা করে দেশে সৎ নেতৃত্ব তুলে ধরা (জীবনে যা দেখলাম,৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৪)।

নির্বাচনের পরে ৮ জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগকে অভিনন্দনও জানিয়েছিলেন গোলাম আজম। এবং এরপরই জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার বৈঠক হয়। সেখানে গোলাম আজম স্পষ্ট করেই বলেন, নির্বাচনের ফলাফল বলে দিচ্ছে রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে গেল। তিনি বলছেন-

  • "মুসলিম জাতীয়তার যে ভিত্তিতে ভৌগলিক দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন দুটো ভূখণ্ড মিলে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিলো, পাকিস্তানি শাসকরা ঐ ভিত্তিটিই ধ্বংস করে দিয়েছে। পূর্ব-পাকিস্তানে এখন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সেই শূণ্যস্থান দখল করে করেছে। আমি নিশ্চিত যে, নির্বাচনের ফলে উভয় অঞ্চলে নতুন যে নেতৃত্ব জেগে উঠেছে তারা দু'অঞ্চলকে একই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত থাকতে দেবে না বা রাখতে পারবে না (জীবনে যা দেখলাম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৮)।"

এতটা নিশ্চিত হয়ে গোলাম আজম আরও এক ধাপ এগিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন সেই শূরা বৈঠকে। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায়, তাতে জামায়াতের বিরোধিতা করার কিছু নেই বলেই মনে করেছিলেন তিনি। সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা থাকবে না একসাথে থাকবে সেই সিদ্ধান্তের এখতিয়ার দলের পূর্ব পাকিস্তান শাখার ওপর ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। তখন মাওলানা মওদুদী এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, মজলিশে শূরা একমত হলে স্বায়ত্বশাসন নয়, পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হবে (ঐ)।

বৈঠকের এই বর্ণনা পড়লে মনে হতে পারে, জামায়াতে ইসলামী মনে করে সেই সময়ের সামরিক সরকার ইসলামের পক্ষের যথার্থ শক্তি নয় এবং তাদের ব্যর্থতাই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে উস্কে দিয়েছে। তাই সেই জালিম সরকার যদি গণমানুষের উপরে আক্রমণ করে, তার প্রতিবাদও জামায়াতের করা যুক্তিসঙ্গত ছিল। কিন্তু ২৫ মার্চের নৃশংস আক্রমনের পরে এই যুক্তি কেন যেন আর কাজ করেনি দলটির মধ্যে।



২। ২৫ মার্চ সম্পর্কে গোলাম আজম

"যে নৃশংস দৃশ্য দেখলাম তাতে মনে হলো যে, সেনাবাহিনী যেন কোন শত্রুদেশ জয় করার জন্য আক্রমণ চালিয়েছে।"- ২৬ মার্চ ১৯৭১ এর দৃশ্য প্রসঙ্গে গোলাম আজম।

২৫ মার্চ রাতে গোলাম আজম গোলাগুলির শব্দ আর আগুন দেখে বুঝতে পারেন, সেনাবাহিনী 'শহর দখলের জন্য শক্তি প্রয়োগ করেছে' (জীবনে যা দেখলাম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩০)। ভোর তিনটার আগে ঘুম আসেনি তার। পরদিন সকাল আটটায় দলীয় 'ভক্সওয়াগনে' চড়ে তিনি বেরিয়েছিলেন শহরের অবস্থা দেখতে। প্রথমেই গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, দেখেছেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বস্তিদের দৃশ্য-

  • "সেখানে যে বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়েছে তা বড়ই অমানবিক ও করুণ। এ বস্তিগুলোতে নারী-পুরুষ, শিশু, গাভি, বাছুর মরে পড়ে আছে। তখনও সেসব সরাবার কোন ব্যবস্থা হয়নি। কিভাবে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালালো তা বুঝতে পারলাম না। গুলীর আঘাতে নিহত বলে মনে হয়নি। আগুন দিয়েও পুড়িয়ে মারা হয়নি। বস্তির জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়নি বটে, কিন্তু কালো হয়ে পড়ে আছে। কোন রকম গ্যাস বা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে (পৃষ্ঠা ১৩৩)।"

এখান থেকে তিনি আরও গিয়েছিলেন নয়াবাজার, বংশাল রোড, ইসলামপুর, নওয়াবপুর ও গুলিস্তানে। পথে পথে যা দেখেছেন, সেই প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন-

  • "যে নৃশংস দৃশ্য দেখলাম তাতে মনে হলো যে, সেনাবাহিনী যেন কোন শত্রুদেশ জয় করার জন্য আক্রমণ চালিয়েছে। বিদ্রোহ দমন করার জন্য কারফিউ জারি করে রাস্তায় যাদেরকে পাওয়া যায় তাদেরকে গুলী করে হত্যা করার হুমকিই যথেষ্ট ছিলো। বস্তিতে ঢুকে মানুষ-পশুকে একসাথে হত্যা করার কী প্রয়োজন ছিলো? (পৃষ্ঠা ১৩৩)।"

দেখা যাচ্ছে, হত্যার হুমকি পর্যন্ত মেনে নিতে তিনি রাজি ছিলেন। কিন্তু যখন সত্যিই হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল, তখন তো সামরিক সরকারের এই নৃশংসতার নিন্দা জানানোটাই ছিল স্বাভাবিক; বিশেষ করে যেই সরকার কোনমতেই ইসলামের স্বার্থ রক্ষাকারী নয়!


অথচ এই ২৫ মার্চ নিয়ে কখনই কোন বিবৃতি দেয়নি জামাতে ইসলামী! একবারও তারা সামরিক সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেনি, তোমরা গণহত্যা চালিয়েছ। এর বিচার চাই।



৩। টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ

সেই সময় যে গণহত্যা চলেছে এটা গোলাম আজম নিজে দেখেছেন এবং বলেছেন। সেই গণহত্যা যে সামরিক বাহিনী চালিয়েছে, সেটাও তিনি জানতেন। তাহলে ঐ বৈঠকে কেন গেলেন তিনি?

এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে জেনারেল টিক্কা খানের সাথে দেখা করেন গোলাম আজম; উদ্যোগ ছিল টিক্কা খানেরই। জনাব আজম, নিজের ভাষায়, টিক্কা খানের কথা শুনতে গিয়েছিলেন (পৃষ্ঠা ১১৮)। দৈনিক পাকিস্তানের ৫ এপ্রিল সংখ্যায় ব্যানার হেডলাইন ছিল- জেনারেল টিক্কা খান সকাশে নেতৃবর্গ। এতে বলা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ১২ জন রাজনীতিবিদের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকার খ অঞ্চলের সামরিক আইন শাসনকর্তা লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের সাথে দেখা করেন। সেই রাজনীতিবিদের মধ্যে নাম রয়েছে গোলাম আযম'রও।

নেতৃবর্গ ঢাকা ও প্রদেশে অন্যান্য স্থানে দ্রুত পুর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সামরিক আইন শাসনকর্তাকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

এখানেও লক্ষ্যনীয়, সেই সময় যে গণহত্যা চলেছে এটা গোলাম আজম নিজে দেখেছেন এবং বলেছেন। সেই গণহত্যা যে সামরিক বাহিনী চালিয়েছে, সেটাও তিনি জানতেন। তাহলে ঐ বৈঠকে কেন গেলেন তিনি? বা সহযোগিতার আশ্বাসই বা দিলেন কেন!

গোলাম আজম'র নিজের লেখায় ব্যাপারটা এসেছে একটু ভিন্নভাবে।

বৈঠকে তিনি গিয়েছিলেন এবং টিক্কা খান'কে দুটো প্রশ্ন করেছেন। প্রথম প্রশ্ন ছিল, আইন-শৃঙ্খলা বহাল করার জন্য কোটি কোটি টাকার সম্পদ পুড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিল কি না এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন- ছাত্রদের হলে ঢুকেও কি তাদের হত্যা করার দরকার ছিল? (পৃষ্ঠা ১৩৯)

জবাবে টিক্কা খান বলেছিলেন, পথে পথে কিছু রিকশাওয়ালাকে হত্যা করে এবং কোথাও কোথাও আগুন লাগিয়ে ভীতি সৃষ্টি করা না হলে হাজার হাজার মূল্যবান জীবন নাশ করতে হতো। আর হলগুলোতে কতক সশস্ত্র বিদ্রোহী ছিল, খুব অল্পসংখ্যক ছাত্রই নিহত হয়েছে। মজার ব্যাপার হল, গোলাম আজম সেই বক্তব্যের কোন প্রতিবাদ করেননি। মিটিং এ করেননি, মিটিং এর বাইরে এসেও করেননি। বরং এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে জামায়াত ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম, প্রচার সম্পাদক জনাব নূরুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক গোলাম সরোয়ার এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন-

  • "ভারত পাকিস্তানের মাটিতে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানীদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ভারতীয়দের জানা উচিৎ যে, দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানীরা কখনো কোন দেশের সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের রক্ষাকর্তা বলে গণ্য করবে না।"

আমরা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি যে, অনুপ্রবেশকারীদের যেখানেই দেখা যাক পূর্ব পাকিস্তানীরা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ভারতকে খেলা করতে দিবে না (দৈনিক পাকিস্তান, ৮ এপ্রিল)।"

কোথাও সামরিক শাসকের বর্বরতা নিয়ে একটি কথাও নেই!



৪। একাত্তরে করণীয় নির্ধারণ

জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, ২য় খণ্ড'তে আছে - আদর্শভিত্তিক সংগঠন হিসেবে জামায়াতের মজলিসে শূরায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনটি পথের মধ্যে কোনটি গ্রহণ সম্ভব ও সমীচীন তা নির্ধারণ করতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে; গোলাম আজম নিজেও বুঝতে পারছেন, দলের বৈঠকে বলছেন, বিচ্ছিন্নতা অনিবার্য। তাহলে দল হিসেবে ঐ পরিস্থিতিতে কি ভূমিকা রাখতে পারতেন তারা?

গোলাম আজম বলছেন, এই অবস্থায় জামাতের আসলে কিছুই করার ছিল না। তার সাথীদের মধ্যে ২/৩ জনের সাথে কথা বলেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। তিনি লিখেছেন-

  • "আমরা একমত হলাম যে, আমাদের কোন ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই। একদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, অপরদিকে আওয়ামী লীগ। এ পরিস্থিতিতে জামায়াতের গুরুত্বই বা কি আছে? তাই আমাদের এ সময় চুপ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া কিছুই করার নেই। আমি আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরী গোছানো শুরু করলাম। লেখাপড়া করেই সময়টা কাজে লাগাতে হবে বলে অনুভব করলাম (পৃষ্ঠা ১৩৪)।"

কিন্তু লেখাপড়ায় তিনি মন বসাতে পারলেন না।

'জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, ২য় খণ্ড'তে আছে - "আদর্শভিত্তিক সংগঠন হিসেবে জামায়াতের মজলিসে শূরায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনটি পথের মধ্যে কোনটি গ্রহণ সম্ভব ও সমীচীন তা নির্ধারণ করতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছে (পৃষ্ঠা ২২৮)। যে তিনটি পথ তাদের জন্য খোলা ছিল বলে তারা ভেবেছিলেন, সেগুলো হল-

  • ক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়া -
  • এটি বাতিল হয়ে যায়, কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আন্দোলন তাদের আদর্শবিরোধী

  • খ। নিষ্ক্রিয় হয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা -
  • এটি রাজনৈতিক কোন দলের পক্ষে সম্ভব না

  • গ। সেনাবাহিনীর জুলুম থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করা এবং তাদের ভারতের আধিপত্য সম্পর্কে সাবধান করা-
  • কেবল এই পথটিই খোলা ছিল (জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভূমিকা/ গোলাম আজম)।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, চার নাম্বার পথের কথা জামায়াতে ইসলামী কেন বিবেচনায় নিল না! যা হতে পারত- জনগণকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানী সামরিক বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণকে নিজেদের মতাদর্শের পক্ষে টানা। ঠিক যে কাজটি করেছিলেন সিরাজ সিকদার, বরিশাল থেকে। জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবেই ঠিক করে, "টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে তাঁর সরকারের সাথে যে যোগাযোগ হয়েছে তা বজায় রেখেই এ জাতীয় সেবা করতে হবে (পৃষ্ঠা ১৪৪)।" অর্থাৎ জনগণকে সামরিক জুলুম থেকে রক্ষা করতে হবে!

এই প্রসঙ্গে চব্বিশের গণভ্যুথহানের লাইনটা মনে পড়ে- খুনির কাছে কি খুনের বিচার চাওয়া যায়!

৫। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী

মে মাস জুড়ে শান্তি কমিটি দেশজুড়ে সফর করে এবং সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়।

ঢাকায় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করার জন্য ১৪০ সদস্যের শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল ১৩ এপ্রিল। এই কমিটি ১৪ এপ্রিল প্রথম বিরাট মিছিল করে ঢাকায়। ব্যানারের সামনের সারিতেই ছিলেন গোলাম আজম (দৈনিক পাকিস্তান, ১৪ এপ্রিল)।

মে মাস জুড়ে শান্তি কমিটি দেশজুড়ে সফর করে এবং সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়। স্বাভাবিকভাবেই এই শান্তি কমিটি মুক্তিযোদ্ধাদের টার্গেটে পরিণত হয়। তবে গোলাম আজম এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন- মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি কমিটির সাথে শত্রুতা না করলে জনগণের পর্যায়ে শান্তি কমিটি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হত না (পৃষ্ঠা ১৫৮)।

তার এই যুক্তি বোঝা অবশ্য একটু মুশকিল। সামরিক বাহিনীর দমনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে মুক্তিযোদ্ধা আর সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্যই তৈরি হয়েছিল শান্তিবাহিনী। এদের মধ্যে বিরোধ থাকাটা ছিল অনিবার্য।

ঐ মে মাসেই গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী। মুনতাসির মামুন'র মতে, এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল খুলনায় জামায়াতের কর্মীদের দ্বারা এবং নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াত নেতা এএকএম ইউসুফ। কিন্তু গোলাম আজম'র বিবরণ এখানে ভিন্নরকম। তিনি বলছেন, ইয়াহিয়া সরকারের নির্দেশে সেই সময়ের থানা কর্মকর্তারা মাইকিং করে 'রেজাকার' বা স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করত এবং তাদের সামান্য ভাতাও দিত (পৃষ্ঠা ১৪৬)। এদেরকে ব্যবহার করা হত অনেকটা কমিউনিটি পুলিশের মত করে। এদের সম্পর্কে খুব পক্ষপাতদুষ্ট মন্তব্য জনাব আজম'র বইতে দেখা যায় না। বরং রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে বেশ নিরাসক্তভাবেই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন (পৃষ্ঠা ১৪৬)।

৬। ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাৎ

মাওলানা মওদুদীর গোলাম আজম দেখা করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে। তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেন- "জনগণের নির্বাচিত নেতা ও দলের সাথে মীমাংসা করা ছাড়া কোন সমাধানই টিকবে না


১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বৈঠক বসে লাহোরে। সেখানে গোলাম আজম রিপোর্ট পেশ করে বলেন-

  • "বেসামরিক গভর্নর ও মন্ত্রিসভার পরিচালনায় প্রাদেশিক সরকারের ভূমিকায় জনগণের মধ্যে যারা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না, তারা মোটামুটি সন্তুষ্ট (পৃষ্ঠা ২০৫)।

তারপরই আবার বলছেন-

  • "সেনাবাহিনীর আচরণে জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করছে। যারা পূর্বে বিরোধিতা করত, তারাও আর বাধা দেয় না। সীমান্ত এলাকায় রেজাকাররাও আর মুক্তিযোদ্ধাদের মুকাবিলায় এগিয়ে আসে না।"

এই উপলব্ধি দলের পরিসরে খোলাখুলিভাবে জানিয়েছেন গোলাম আজম। কিন্তু সাংবাদিকদের সামনে তার সুর ছিল ভিন্নরকম। তিনি বলেন-

  • "বর্তমান মূহুর্তে আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করাই হবে দেশের জন্য আত্মরক্ষার সর্বোত্তম ব্যবস্থা।" সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে সকল দেশপ্রেমিক, শান্তি কমিটির সদস্য এবং রেজকারদের উন্নতমানের ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত করার দাবি জানান তিনি (দৈনিক সংগ্রাম, ২৪ নভেম্বর)।

মাওলানা মওদুদীর পরামর্শে সেই দফায় গোলাম আজম দেখা করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে। সেখানে তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেন- জনগণের নির্বাচিত নেতা ও দলের সাথে মীমাংসা করা ছাড়া কোন সমাধানই টিকবে না (পৃষ্ঠা ২০৭)।

 শেষ কথা

দেখা যাচ্ছে, সেই প্রথম থেকেই গোলাম আজম দলীয় সভায় যে বিশ্লেষণ রাখছেন, জনগণের সামনে তার সম্পূরক বক্তব্য দিচ্ছেন না। দলীয় সভায় বলছেন, সামরিক বাহিনী অন্যায় করছে, অধিকাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে চলে গেছে। কিন্তু প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীকে তিনি সমর্থন যোগাচ্ছেন, সেনা শাসিত সরকারের প্রধানের সাথে দেখা করে তাকে অখণ্ড পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতে পরামর্শ দিচ্ছেন।

একদিকে শান্তিবাহিনী ও রেজাকার বাহিনী নিয়ে নিরাসক্তি দেখাচ্ছেন, অন্যদিকে বক্তৃতা বিবৃতিতে এদের উন্নত ট্রেনিং ও অস্ত্র দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।

দলের ভিতরে বলছেন, এই পাকিস্তান টিকে থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু পুরো ১৯৭১ জুড়ে চালালেন অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার সংগ্রাম।



যারা জনাব গোলাম আজম'র জীবনী পড়তে আগ্রহী, তারা এই লিংকে পড়ে নিতে পারেন- https://shibircloud.com/pdf/jibone_ja_dekhlam_3.pdf

পড়ে দেখতে পারেন