১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতিতে কি কি সমস্যা ছিল?

৭২ এর সংবিধান বাতিল বা পুনর্লিখনের যে দাবি নিয়ে আলোচনা, সেটা অন্য আলাপ। এই সংবিধান যেভাবে গৃহীত হল, প্রথমে সেইদিকে মনযোগ দেয়া যাক। নানা বিষয়ে ভয়ায়বহ বিরোধ থাকলেও, এই প্রসঙ্গে দুই মহীরুহ বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান আর ফরহাদ মজহার'র বিশ্লেষণ প্রায় একই রকম। বর্ষীয়ান বামপন্থী বদরুদ্দিন উমর'র মতামতও কাছাকাছি।
মোটা দাগে দুটো বড় অভিযোগ আছে এই সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতি নিয়ে।
এক। ১৯৭০ সালের নির্বাচিত প্রদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে কেন গণপরিষদ গঠিত হল? ওরা তো নির্বাচিত হয়েছিল অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য রেখে। স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নের অধিকার কি তাদের আছে?
দুই। নামকাওয়াস্তে গণপরিষদ করে কার্যত শেখ মুজিবের পরামর্শে এই বিষয়ে অযোগ্য ড কামাল হোসেন, বিদেশীদের সহযোগিতায় এই সংবিধান লিখেছেন।
গণপরিষদের সদস্য

- 'জনাব সলিমুল্লাহ খান ১৯৭২ এর সংবিধান নিয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে প্রায়ই বলেন-
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূলনীতির সাথে এই সংবিধান সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
১৯৭০ এর নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ছিল ৩০০; এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ছিল ১৬৯ টি আসন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ জিতেছিল ১৬৭ টি'তে। পাকিস্তানের আইনে এরা সবাই গণপরিষদের সদস্য হওয়ার যোগ্য। এর বাইরে যুক্ত হয়েছিল প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন ৩০০ জন।
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের মোট ৪৬৯ টি আসনের মধ্যে ৫ জন ছিলেন শহীদ, ৫ জন স্বাভাবিকভাবে মৃত।
২৩ জনকে আওয়ামী লিগ বহিষ্কার করেছিল আর ২ জন পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। এর বাইরে ৪ জন পাকিস্তানের সাথে সহযোগিতার অপরাধে জেলে ছিল। ফলে বাদ পড়ে ৩৯ জন।
বাকি ৪৩০ জন নিয়ে শুরু হয় গণপরিষদ।
পরে শৃঙ্খলাভঙ্গসহ নানা অভিযোগে বাদ পড়ে আরও ২৬ জন। ১৯৭২ এর অক্টোবরে গণপরিষদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০৪ জনে।
এদের মধ্যে মাত্র ৩ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের বাইরে- সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মানবেন্দ্র লারমা ও মোহাম্মদ আজিজ চৌধুরী।
এখানে উল্লেখ্য, জনাব সলিমুল্লাহ খান ১৯৭২ এর সংবিধান নিয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে প্রায়ই বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূলনীতির সাথে এই সংবিধান সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অথচ, এই ঘোষণাপত্রেই গণপরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছিল এইভাবে- ১৯৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ী প্রতিনিধিদের নিজেদের সমন্বয়ে একটি গণপরিষদ গঠন করা হবে।
ঠিক একইভাবে গঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের গণপরিষদ। ১৯৪৬ সালের শুরুতে অখণ্ড ভারতে অনুষ্টিত হয় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। এই নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত হয় গণপরিষদের সদস্যরা। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পরে পাকিস্তান অংশের গণপরিষদ সদস্যদের নিয়েই গঠিত হয় 'পাকিস্তান গণপরিষদ'।
খসড়া কমিটি

খসড়া কমিটি প্রথমবারে বসে, ১৭ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্রিল।
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। দুই দিন স্থায়ী অধিবেশনে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করা হয়। ১১ এপ্রিল গঠিত হয় 'খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি'। এই কমিটির সদস্য ৩৪ জন, চেয়ারম্যান করা হয় আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ড কামাল হোসেন'কে। এদের কাজ ছিল ১০ জুন এর মধ্যে 'বিল আকারে শাসনতন্ত্রসহ তাদের রিপোর্ট' পেশ।
কমিটি জনগণের মতামত আহ্বান করে সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। কিন্তু প্রস্তাবনা আসে মাত্র ৯৮ টি। (Abul Fazl Huq, 1973, Constitution making in Bangladesh)।
খসড়া কমিটির কাজের ধারা
খসড়া কমিটি প্রথমবারে বসে, ১৭ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্রিল।
দ্বিতীয় দফায় বসে ১০ মে থেকে ২৫ মে। এই দফা বৈঠকের পরে খসড়া তৈরি হয়।
তৃতীয় দফায় বসে ৩ জুন থেকে ১০ জুন। এই সময়ে খসড়া নিয়ে আলোচনা হয় ও নানা সংশোধনী যুক্ত হয়। এরপরে খসড়াটির ভাষাগত দিক পরীক্ষা করে দেখে একটি কমিটি; যার প্রধান ছিলেন ড আনিসুজ্জামান। এরপর 'খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি' আবার দুই দফা বৈঠকে বসে।
এর মাঝে ১৩ জুন ড কামাল হোসেন দশ দিনের সফরে ভারত ও লন্ডনে যান (দৈনিক সংবাদ, ১৩ জুন ১৯৭২)। অনেকেই মনে করেন, এই সময় সংবিধান নিয়ে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলেছেন এবং এর ইংরেজি সংস্করণের জন্য কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের সহায়তা চেয়েছিলেন।
প্রথমে, ১০ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয়ে, ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১১ সেপ্টেম্বর।
আলোচনা ও পূর্নাঙ্গ সংবিধান

গণপরিষদের ৪০৪ জন সদস্যদের মধ্যে মাত্র ৪৮ জন আলোচনায় অংশ নেন।
কমিটির বাইরে আলোচনা
কমিটির নিজেদের বৈঠকের বাইরে কিছু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা হয়েছিল। শেখ মুজিব নিজে, ড কামাল'র সাথে এই ইস্যুতে দুই বার বৈঠক করেন (ড আনিসুজ্জমান)। তার পরামর্শে ৩৮ (ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করা) ও ৭০ (ফ্লোর ক্রসিং) ধারায় সংশোধনী আনা হয়। এর বাইরে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ এবং জেনারেল ওসমানী'র সাথে কথা হয়েছিল বলে জানা যায়। আলোচনা হয়েছিল ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সাথেও।
গণপরিষদে আলোচনা
গণপরিষদে খসড়া সংবিধান নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ১৯ অক্টোবর। প্রথম দিনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দাবি ছিল, ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি রেখে খসড়া সংবিধানটি জনগণের মধ্যে বিতরণ করে জনমত যাচাই করা হোক। তাকে সমর্থন করেন স্বতন্ত্র সদস্য এমএন লারমা। কন্ঠভোটে এই প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়।
আলোচনা চলে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত। ৪০৪ জন সদস্যদের মধ্যে মাত্র ৪৮ জন আলোচনায় অংশ নেন।
'সেকেন্ড রিডিং' চলে ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। আসে ১৬৩ টি সংশোধনী। এর মধ্যে ৭০ টি দেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর ২৫ টি দেন এমএন লারমা। পাশ হয় ৮৪ টি সংশোধনী। এর ৮৩ টিই ছিল সরকার দলীয় সদস্যদের সংশোধনী; মাত্র একটি সুরঞ্জিত'র।
খসড়া সংবিধানের 'ফাইনাল রিডিং' হয় ৪ নভেম্বর, দুই ঘন্টারও কম সময়ে। গৃহীত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ'র সংবিধান, গণপরিষদে উত্থাপনের মাত্র ২৪ দিনের মাথায়। সংবিধানের স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠান হয় ১৪ ডিসেম্বর।
পদ্ধতিটি কি গণতান্ত্রিক ছিল?

গণপরিষদের আলোচনার ২৫% ই করেছেন দুইজন সদস্য- সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর এমএন লারমা।
দৃশ্যত, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতিকে অগণতান্ত্রিক বলার সুযোগ কম। খসড়া কমিটি গঠন, এই নিয়ে নিজেদের আলোচনা, আন্তর্জাতিক আইনের উপর পড়াশোনা, বাইরের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের আলোচনা, গণপরিষদে আলোচনা- সবই হয়েছে। গণপরিষদের আলোচনার ২৫% ই করেছেন দুইজন সদস্য- সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর এমএন লারমা। কিন্তু কার্যত, আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি কমিটি যেভাবে চেয়েছে, তার বাইরে কিছু ঘটার সুযোগ আসলে ছিল না। তার উপর আওয়ামী লীগের সদস্যদের ১৯৭২ এর 'দ্য কন্সটিটুয়েন্ট এসেম্বলি অর্ডার' অনুসারে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না।
ভারতে কি আসলে লেখা হয়েছিল?
আসলে কোথায় লেখা হয়েছে সংবিধান, কে লিখেছে, সেটা নিয়ে যারা বিতর্ক করেন, তথ্য প্রমাণ হাজির করার দায়িত্ব তাদের উপরই বর্তায়। তবে কিভাবে সংবিধান প্রণয়ন হয়েছে, সেই পুরো প্রক্রিয়াটা দেখলে বিদেশে বসে সংবিধান লেখা হয়েছে, তার অবকাশ দেখা যাচ্ছে না।
সংবিধানের বিপরীতে অনেক সময় দাঁড় করানো হয় ঘোষনাপত্রকে। বলা হয়, ঘোষণাপত্রের প্রতিফলন সংবিধানে নেই। কিন্তু আমীর-উল-ইসলাম’র ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ থেকে জানা যায়, ঐ ঘোষণাপত্রের খসড়া এককভাবে তার হাতে তৈরি।
সেই সময়ের সমালোচনা
খসড়া সংবিধান নিয়ে সরব ছিলেন মাওলানা ভাসানি। এখন সলিমুল্লাহ খান যে সমালোচনা করছেন, সেটা আসলে ভাসানি’র কথা। তিনিই বললেন, এই গণপরিষদের সংবিধান রচনার আইনগত অধিকার নেই। কারণ এর সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছিল ইয়াহিয়ার অধীনে পাকিস্তান সংবিধান রচনা করার জন্য।
ভাসানী বলেন, “একটি বাজে গণপরিষদ কর্তৃক জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া সংবিধান বাতিল করে সরকারের ভেতরের ও বাইরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নতুন খসড়া সংবিধান তৈরির জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত।”
আবুল মনসুর আহমদ, ১২ নভেম্বর ইত্তেফাকের উপ সম্পাদকীয়তে লিখেন-
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্ট (লেনিনবাদী) ছিল পিকিংপন্থী বামপন্থী। তাদের দৃষ্টিতে- এই সংবিধানে ‘বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী পুজি’ বাজেয়াপ্ত বা ‘সামন্তবাদ বিলোপ’র কোন বিধান নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের সমবায়ে জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটের মাধ্যমে তা গ্রহন করতে হবে।
শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সমালোচনা ছিল অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট। তারা বলেন- ‘মূলনীতিসমুহ কার্যকর করার জন্য আদালতের শরাণপন্ন হোয়ার অধিকার এখানে অস্বীকার করা হয়েছে। (দৈনিক বাংলা, ১৯ অক্টোবর, ১৯৭২)।’
সদ্য গঠিত জাসদ নেতা আ স ম আব্দুর রব বলেন, এটি একটি বাজে সংবিধান। তবে একেবারে না থাকার চেয়ে একটি বাজে সংবিধানও ভাল।… এখানে রাষ্ট্রপতিকে ‘শো বয়’ আর প্রধানমন্ত্রীকে সর্বেসর্বা করা হয়েছে।’
সিপিবি মনে করে, কিছু অগণতান্ত্রিক ধারা সহ সংবিধানটি ‘মোটামুটি গণতান্ত্রিক’। একে সমাজতন্ত্রমুখী করে তুলতে তারা ১২ দফা দাবি পেশ করে (বাংলাদেশের রাজনীতিঃ সঙ্ঘাত ও পরিবর্তন/ আবুল ফজল হক)।