সোনার বাংলা ঠিক কবে থেকে শ্মশান হল?

image
মুঘল আমলে? না কি সুলতানী আমলে? না কি বাংলা সালের প্রবক্তা শশাঙ্ক'র আমলে?- কখন ছিল সোনার বাংলা?

সোনার বাংলা শ্মশান কেন?

প্রশ্নটা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ রেখেছিল একটি পোস্টারে। দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য তুলে ধরা হয়েছিল কলাম করে। একদম অংক করে দেখানো সেই বৈষম্যের চিত্রটা ছিল ধাক্কা দেয়ার মত। এবং ধাক্কা খেয়ে যে কেউই নিশ্চয়ই ভাবতে পারে, এক সময় আমার বাংলাটা ছিল সোনার, কিন্তু আজ পাকিস্তানি শাসনে সে হয়ে গেছে শ্মশান!

এই সূত্র ধরেই ভাবতে বসা, এই 'সোনার বাংলা' বলতে আসলে ঠিক কোন সময়টার কথা বলা হয়েছে? ব্রিটিশ আমল?

মানা মুশকিল। কেননা, আমাদের রাজনীতিতে একটি জনপ্রিয় বাক্য- দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসনে চরম শোষণে বাংলার মানুষ নিঃশেষিত হয়ে গেছে।

তবে কি মুঘল আমলে? না কি সুলতানী আমলে? না কি বাংলা সালের প্রবক্তা শশাঙ্ক'র আমলে?- কখন ছিল সোনার বাংলা?


কখনো ছিল কি?

  • মনে আছে নিশ্চয়ই, এই শব্দবন্ধ আমাদের শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
  • ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট গানটি প্রথম গাওয়া হয়।

তার গানে শব্দের ব্যবহার খুবই স্পষ্ট।

১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট এই গানটি যখন প্রথম গাওয়া হচ্ছিল, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি, তার বছর খানেক আগে ১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে লর্ড কার্জন প্রকাশ করেছেন বঙ্গ'কে ভঙ্গ করার ইচ্ছা। সেই ১৭৬৫ সাল থেকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বলতে বোঝাত অখণ্ড বাংলা, বিহার আর উড়িষ্যা। এইবার বলা হল, না, আজকের বাংলাদেশ আর আসাম মিলে হবে পূর্ববঙ্গ।

সেই প্রেক্ষাপটে লেখা গানটিতে 'সোনার বাংলা' মানে প্রিয় বাংলা, আদরের বাংলা।

এই বাংলা একটা অখণ্ড সত্তা নিয়ে দাঁড়াতে শুরু করার সময় খুব বেশদিন আগের নয়।

বাঙ্গালী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। হরিকেলে, সমতটে, বঙ্গে, চন্দ্রদ্বীপে আর পট্টিকেরায়। এদের এক করার চেষ্টা করেছিলেন রাজা শশাঙ্ক (৭ম শতাব্দী), চেষ্টা করেছেন পাল রাজারা (৭৫০ - ১১৬২)। ব্যর্থ হয়েছিলেন সবাই।

সফল হয়েছিলেন কেবল সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২ - ১৩৫৭)।

বাংলার সব অঞ্চলকে একত্র করে নাম দিয়েছিলেন- 'বাঙ্গালা'। নিজে হলেন 'শাহ ই বাঙ্গাল' বা বাংলার রাজা। একই রাজ্যের অধীনে আসার কারণেই এই এলাকায় ভাষাগত সমরূপতা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। মুসলিম শাসকরাও উৎসাহ যুগিয়েছিলেন ভাষা আর সাহিত্য চর্চায়।

তাদের আগের হিন্দু আর বৌদ্ধ শাসকদের চোখে বাংলা বা দেশী ভাষা ছিল অপবিত্র, স্থূল।



প্রতিযোগিতার ফল

স্থানীয় মানুষদের পক্ষে আনার লড়াইয়ে প্রয়োজন পড়ে দেশী ভাষায় মানুষদের বোঝানোর।

কিন্তু আরেকটা ব্যাপার ঘটে গেল।

নতুন করে ছড়াতে থাকা ইসলাম আর সেই সময় বৈষ্ণববাদ হিসেবে পুনরীজ্জীবিত হিন্দু ধর্মের মধ্যে শুরু হল প্রতিযোগিতা। যার যার বাণী প্রচার করে স্থানীয় মানুষদের পক্ষে আনার লড়াইয়ে প্রয়োজন পড়ে দেশী ভাষায় মানুষদের বোঝানোর। ফলে, রচিত হতে থাকে সাহিত্য। এগুতে থাকে বাংলা ভাষা।

ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভ্রূণ কি তাহলে সেখানেই রোপিত হতে শুরু করেছিল?

সেটাও অত সহজে বলা যায় বলে মনে হয় না।

এরপর মুঘল এসেছে, ব্রিটিশ এসেছে, কিন্তু বাংলাভাষী মানুষের স্বতন্ত্র ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়ে দাঁড়ানোর নজির প্রায় নেই। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেটাকেও ঠেলে দেয়া হয়েছে ভিন্ন খাতে। বলা হয়েছে, ওটা কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু বাঙ্গালীদের আন্দোলন। পূর্ব বাংলা আলাদা হলে এই অঞ্চল হবে মুসলমান বাঙ্গালীদের।

এই অঞ্চলে যে ভাষা আর ধর্মের যে একটা বিরোধ আছে, সেটা নতুন করে বলার কিছু নেই। পাকিস্তান আন্দোলনে এই অঞ্চলের বাংলাভাষীরা স্বেচ্ছায় একই ধর্মের, কিন্তু ভিন্নভাষী মানুষের সাথে, ভৌগোলিক দূরত্ব নিয়েও রাষ্ট্র সৃষ্টির সিদ্ধান্তে এসেছিল। আবার সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ এখানে ছিল অক্ষরজ্ঞান শূন্য। তাদের ভাষা নিয়ে কোন আবেগ কাজ করার কথায় নয়। ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক আলাপ, এবং ১৯৫২ সালের আগে কখনই সেই আলাপ উঠেনি বা শোনা যায়নি।



ছিল কি সেই সোনার বাংলা?

কবিরা তার মত করে ইতিহাসকে দেখেন, তার রোমান্টিকতা সবসময় ইতিহাসের বাস্তবতা নয়।

তাহলে সেই প্রশ্ন আবার উঠে- 'সোনার বাংলা' কি আগে কখনো ছিল?

লোকমান ফকির'র গানে যেমন আছে-

"আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা অঘ্রানে নবান্নে উৎসবে, সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়, বিশ্ব অবাক চেয়ে রবে।। আবার ভিড়বে এসে বাংলার বন্দরে বেসাতির বড় বড় মহাজন, আবার খুঁজবে তারা সোনাফলা বাংলায় হীরেমণি জহরত কাঞ্চন। বাংলার গল্পে গানে ও কথায় বিশ্বের আঙিনা মুখর হবে।। আবার আনবে ফিরে বিশ্বের সম্মান বাংলার কথা আর কবিতা মুক্তির ইতিহাস পৃথিবীর বিস্ময় বাস্তব স্বপ্নের ছবিটা পথে ঘাটে প্রান্তরে ঘরে আঙিনায় সৌরভে ভরা প্রাণ গৌরবে।।"

'কবিরা তার মত করে ইতিহাসকে দেখেন, তার রোমান্টিকতা সবসময় ইতিহাসের বাস্তবতা নয়। এই গানে যেসব 'সোনার বাংলা'র ইমেজ আছে- নবান্ন, বন্দর বাণিজ্য, দেশের সম্পদ, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল। বেসাতির জন্য মহাজনদের এখানে আসার সাথে মিশে আছে সাম্রাজ্যের ইতিহাস কিংবা নবান্নের উৎসবের মিথের সাথে আছে রাজাদের কর আদায়ের আয়োজন। তাই বলে কবির রোমান্টিকতা নিশ্চয়ই অপরাধ বলা এখানে উদ্দেশ্য না।

আসলে জাতীয়তাবাদীদের কাছে এমনি একটি স্বর্ণযুগের রেফারেন্স লাগে; আর লাগে সেই যুগে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা। এখানে যেমন 'সোনার বাংলা', আমেরিকার ট্রাম্প'র তেমন 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন'।

পড়ে দেখতে পারেন