ফকির কবিরাজ ওঝা'য় বিশ্বাসের পিছনে কি?

ইংরেজিতে যাকে বলে Shaman, অভিধানে তার বাংলা 'ওঝা'। কিন্তু ওঝা আসলে Shaman দের একটা অংশ মাত্র। পশ্চিমা Shaman দের ভাল আর খারাপ আত্মা, দুই জগতেই আছে প্রবেশাধিকার (মেরিয়াম-ওয়েবস্টার)। সে অসুস্থ মানুষকে ভাল করে দেয়, নিখোঁজের সন্ধান বের করে আনে, মোড় ঘুরিয়ে দেয় জাগতিক সব ঘটনার। আত্মাদের ভাল খারাপ, তাদের ভর করার বাতিক- সব তার নখদর্পনে। মানুষ আর অতিপ্রাকৃত জগতের মধ্যে সে সম্পর্ক তৈরি করে দেয়। কাল জাদু সে করেও, সেটা কেবল মানুষের মঙ্গলের জন্যই।
যদিও Shaman শব্দটা দেখা যায় সপ্তদশ শতাব্দীতে জার্মানি আর রাশিয়ায়, অনেক পণ্ডিতই মনে করে এর উৎপত্তি এশিয়াতেই।
সম্ভবত আমাদের শিকারি যুগেই উদ্ভব হয়েছে এই পেশার (Lessa and Vogt 1979,301)। মূলত অসুস্থকে সুস্থ করে তোলাই ছিল তার কাজ। এর জন্য অনেক 'আত্মা' পুষত সে; যদিও এই আত্মাগুলো তার উপর ভর করার ক্ষমতা রাখত না।
বাংলাদেশে এই Shaman আছে নানা চেহারায়।
কখনো সে পীর ফকির, কখনো সে ওঝা, কখনো কবিরাজ।
জনাব আনোয়ারুল করিম এদের নিয়ে গবেষণা করেছিলেন ১৯৮৮ সালে। তিনি তখন ছিলেন কুষ্টিয়া ফোকলোর রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক। তার গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল এশিয়ান ফোকলোর স্টাডিজ এর ৪৭-২ সংখ্যায়। গবেষণা করতে গিয়ে তার মনে হয়েছে, আধুনিক যুগে সাইকো-থেরাপিষ্টরা যা করে, ঠিক একই কাজ করে বাংলাদেশের সনাতন Shaman রা।
এদের কার্যকলাপে মিশে আছে প্রাচীন লোকধর্ম আর সনাতনী ধর্মের অনেক উপাদান; যা পরে হিন্দু আর বৌদ্ধরাও আত্মস্থ করে নিয়েছে।
এই অঞ্চলে সুফিরা ইসলাম প্রচার করতে এসে, স্থানীয় অনেক প্রথাকেই নিজেদের সাথে মিলিয়ে নিয়েছেন। তৃণমূলে 'আত্মা ব্যবাসায়ীরা' হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য। মজার বিষয় হল, জড়বাদী সংস্কৃতির মধ্যে জন্ম নিয়েও Shaman প্রথা মুসলিম সমাজেও ব্যক্তির জীবনের জটিলতা নিরসনে কাজে লাগতে শুরু করে।
জনাব আনোয়ারুল করিম, তার গবেষণায় দুই রকম Shaman'র কথা বলেছেন তিনি। এক দল, জাদু বা ধর্মীয় মন্ত্র দিয়ে যারা মানুষকে সারিয়ে তোলে; আরেক দল, হার্বাল চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তোলে। এরা গাছ গাছালি, পাতা, ধাতু বা প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে নিরাময়ের উপায় খোঁজে। এই দুই ধারাই বাংলাদেশে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে আছে।
এদের মধ্যে আবার দুটো ক্যাটাগরি আছে- পেশাদার ও অপেশাদার।
অপেশাদারদের মধ্যে আছে পীর, মোল্লাহ আর মুন্সি।
পীর'রা কোরানের আয়াত পড়েন, ফু দেন বা তাবিজ বেঁধে দেন। তাতেই বালা মুসিবত দুর হয় মানুষের। মোল্লাহ বা মুন্সিরা নামাজ পড়ান, মিলাদ বা জানাজা পড়ান; বিশ্বাস দিয়ে মানুষকে সারিয়ে তোলেন। এদের অনেকেই মাদ্রাসায় পড়ান বা অন্য কাজ করেন, কিন্তু ভূমিহীন নন মোটেই। মানুষ ধর্মীয় নানা বিধান বোঝার জন্যও তাদের কাছে যায়।
পেশাদার Shaman যারা, তাদের তিন রকম ধরণ দেখা যায়-
ফকির, ওঝা আর কবিরাজ।
ফকির কারা?
সুফি ধারার এই ফকির, নিজেদের 'ফকির' মনে করে, আল্লাহর দৃষ্টিতে; নিজেদের সম্পত্তির ভিত্তিতে নয়। কঠোরভাবে ধর্মীয় অনুশাসনে এরা জীবন পরিচালনা করে; পাশাপাশি 'ফেইথ হিলার' হিসেবেও কাজ করে। ফকির, নারী বা পুরুষ যে কেউই হতে পারে। এরা অধিকাংশই আসে সমাজের নিম্নবর্গ থেকে। যদিও মুসলিম সমাজে বর্ণপ্রথা নেই, কিন্তু এক ধরনের অভিজাত স্তরবিন্যাস (আশরাফ-আখলাক) তাদের মধ্যেও আছে।
ওঝা কারা?
ওঝারাও ফকির গোত্রের মধ্যেই পড়ে। সম্ভবত শব্দটি এসেছে তুর্কী hodja থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় অনেকটা 'হুজুর'র মতই। এরা বিয়ে পড়ায়, জানাজা পড়ায় বা অন্যান্য ধর্মীয় কাজ পরিচালনা করে। মনে করা হয়, তাদের অধীনে থাকে এক দল 'জ্বিন'। বাংলাতেও 'ওঝা' কাছাকাছি অর্থই বহন করে। শুধু মানুষের নয়, গরুর অস্বাভাবিক অসুখ কিংবা সাপে কাটলেও শিফা'র জন্য কাজ করতে পারে। কিন্তু এদের মূল পেশাই হল সাপে কাটার চিকিৎসা। সাথে জ্বিন ভুত তাড়ানোও এদের কাজ। হিন্দু ওঝারা সাধারণত নিম্নবর্নের হয়। যদিও এটা বংশগত পেশা, অনেক সময় ওঝাদের সর্দার অনেক সময় কোন এক সাগরেদকেও ওঝা হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। এদেরকে মানুষ যতটা না ভালবাসে, তার চেয়েও বেশি ভয় পায়।
আর কবিরাজ কারা?
এরা একই সাথে Shamanism'র কাজ করে আবার হার্বাল চিকিৎসাও দেয়। যোগী বা বেদে'দের কাজও মোটামুটি একই রকম। যোগী বা কবিরাজ সাধারণত নিম্নবর্নের হিন্দু পরিবার থেকে আসে। যোগীরা পুরুষ বা নারী হতে পারে; এদের সংখ্যা বাংলাদেশে একদমই কম। কবিরাজদের আবার শরীরতত্ব সম্পর্কে ভাল ধারনা থাকে। তাদের মতে, মানবদেহে আছে তিন উপাদান- বায়ু, পিত্ত আর শ্লেষ্মা। যদি দেহ, মন আর আত্মায় এই তিনটি উপাদানের ভারসাম্য থাকে, তাহলে কোন অসুখ মানুষকে স্পর্শ করতে পারবে না। এরা পুষ্টি, পরিচ্ছন্নতা, শ্বাস প্রশ্বাস, ধ্যান দিয়ে দেহ আর মনের ভারসাম্য রাখতে শেখায়। হার্বাল চিকিৎসার সাথে এরা কখনো তাবিজও ব্যবহার করে।
বেদেদের কথাও একটু বলে নেয়া দরকার। এরা মুসলিম যাযাবর কিন্তু আল্লাহ আর মুহম্মদের পাশাপাশি রাম-লক্ষণের প্রশংসা করেও গান করে। হনুমানের গল্প পটে আঁকে। মূলত বেদে নারীরাই বৈদ্য হিসেবে কাজ করে। সাপ খেলা দেখানোর পাশাপাশি মন্ত্র দিয়ে মানুষের বালা মুসিবত দুর করে।
হিন্দু মুসলিম দুই রকম Shaman'ই মানবজীবনে গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাস করে। পাশাপাশি আছে শুভ অশুভ সংখ্যার ধারনা। যেমন, তিন, সাত, নয়, এগারো ইত্যাদি। বিশেষ করে সাত সংখ্যার অলৌকিক ব্যাপার তারা স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন- সাত ধাতু (স্বর্ণ, রুপা, তামা, টিন, সিসা, রঙ্ক ও লোহা), সাত স্বর্গ, সাত সমুদ্র, সপ্তর্ষি ইত্যাদি।
নয় সংখ্যায় নিয়েও তাদের মাঝে এমন মিথ আছে- নয় গ্রহ, নয় পাথর, নয় রাত, নয় রস, নয় লক্ষণ, নয় দরজা ইত্যাদি।
মানব শরীর আর স্নায়ুতন্ত্র নিয়েও এর ধারনা রাখে। Shaman'রা স্নায়ুতন্ত্রকে দেখে চক্র হিসেবে। এই চাকা ঠিকমত ব্যবহার করলে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায়।
বাংলাদেশে Shaman'দের ডাক পড়ে আত্মার ভয়ংকর প্রভাবের হাত থেকে বাঁচার জন্য। অদ্ভুত ব্যাপার হল, গ্রামের কৃষক, সে মুসলিমই হোক আর হিন্দুই হোক, কোন না কোনভাবে দেবীর প্রতি নিবেদন করেই। তারা জাদুতে বিশ্বাস করে, মন্ত্রে আস্থা রাখে, অদৃশ্য আত্মার উপস্থিতি মেনে নেয়। তারা মানে, জ্বিন ভুত শরীরে বহুভাবে ঢুকতে বা বেরুতে পারে। আর তার ফলেই ঘটে নানা অনিষ্ট।
জনাব আনোয়ারুল করিম সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন, গ্রামীণ পশ্চাৎপদ মানুষের বিশ্বাসই বাঁচিয়ে রেখেছে Shaman দের। কিন্তু, এই ২০২৫ সালেও খোদ ঢাকা শহরের অনেক দেয়ালে পোস্টার, স্টেন্সিল বা স্টিকার চোখে পড়ে। এখানে লেখা থাকে- তান্ত্রিক সাধু স্বামী স্ত্রীর মনোমালিন্য, অবাধ্য স্ত্রীকে বাধ্য করা থেকে শুরু করে নানা মুসিবত দুর করতে পারে। 'তন্ত্র' শব্দটাই সনাতনী ধর্মের সাথে যুক্ত; এর সাথে মুসলিমদের বিরোধ থাকাটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা। কিন্তু এখন দেখা যায় পোস্টারের শিরোনাম- 'তান্ত্রিক কবিরাজ হুজুর'। তার নিচে লেখা- 'আধ্যাত্মিক তন্ত্র মন্ত্র দ্বারা ২৪ থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে যে কোন সমস্যার সমাধান করে দেয়া হয় ইনশাল্লাহ'। সাথে থাকে ইমো আর হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার। তার ফেইসবুক পেইজও আছে, যেখানে বলা হয়েছে- তিনি ১২ বছর কামরূপ কামাখ্যা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন।
কামরূপ কামাখ্যা সম্পর্কে অনেক মিথ বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে আছে। যারা খোঁজ নিয়েছেন, তারা জানেন, কামরূপ কামাখ্যার সমস্থ মিথই হিন্দু ধর্মের সাথে ভীষণভাবে জড়িত। তবু এই আপাত রক্ষণশীল মুসলিম সমাজেও তন্ত্র মন্ত্রের বাজার আছে বলেই পোস্টার ছাপা হয়, ফেইবুক পেইজে বুস্ট হয়।
তাহলে কি যতই আমরা ধর্মের পরিচয়ে, ধর্মের ভয়ে জীবন যাপনের কথা বলি না কেন, ভিতরে কি আমাদের টানে সেই আদিম রহস্যের আহ্বান? উঠে আসে এই অঞ্চলের শত শত বছরের সনাতনী বিশ্বাসের শক্তি?