পলাশীর যুদ্ধ শুরু করেছিল কোম্পানির কর্মচারীরা?
'সবাই জানে, ঝামেলা ঘটেছে নবাব সিরাজউদ্দৌলা আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে। কিন্তু ইতিহাসবিদ সুশীল চৌধুরী বলছেন, না, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থই মূলত পলাশী'র ঘটনা ঘটিয়েছে (From Prosperity to Decline: Eighteenth Century Bengal/ Sushil Chaudhury, 308)।
কাগজে কলমে অবশ্য কর্মচারীরা কোম্পানির কর্পোরেট স্বার্থকেই প্রধান করে দেখিয়েছে। কিন্তু সেই সাথে বাঁধাধরা বেতনের পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্য দিয়ে তারা টাকা পয়সা জমিয়ে নিতে ছেয়েছিল। যাতে ইউরোপে ফিরে অবসর জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটানো যায়। সেই জন্যই সাগর পাড়ি দিয়ে অচেনা দেশে আসার দুঃসাহস হয়েছিল ওদের। খেয়াল রাখা দরকার, এই কর্মচারীরা ছিল লন্ডন থেকে প্রায় ছয় মাস দুরে; জাহাজে চড়ে লন্ডন থেকে ভারতে আসতে ঐ সময়টাই লেগে যেত। ফোন ছিল না, যোগাযোগের অন্য কোন মাধ্যম ছিল না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা এমনিতেই থাকত তাদের। এই সুযোগে নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে কোম্পানির সম্পদ কাজে লাগাতে তারা কোন দ্বিধা করেনি। ভয় ডর কি কাজ করেনি ওদের মধ্যে?
হয়ত করেছে।
কিন্তু তাদের বিশ্বাস ছিল, ব্যক্তিগত স্বার্থে করুক আর যে কারণেই করুক, ফলাফল যদি হয় কোম্পানির উন্নতি, তাহলে লন্ডন থেকে যে কোন কাজের অনুমোদন পেতে অসুবিধা হবে না।
দাদনি থেকে গোমস্তা
গোমস্তা ব্যবস্থা চালুই হয়েছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যবসায় সুবিধা করে দেয়ার জন্য।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি পেয়েছিল ১৭১৭ সালে। ফরমান জারি করেছিলেন স্বয়ং মুঘল সম্রাট ফররুখসিয়ার। সেখান থেকেই শুরু। বিনা শুল্কের সুবিধা কাজে লাগিয়ে অনেক কর্মচারী ব্যক্তিগত ব্যবসা বাড়ানোর দিকে মন দেয়। এমনকি তাদের 'দস্তক' বা অনুমতিপত্র দেখিয়ে তারা শুল্ক ফাঁকি দিতে সাহায্য করত এশিয়ান ব্যবসায়ীদেরও।
এই নিয়ে নবাব'র দপ্তর থেকে আপত্তিও জানানো হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনমত ঘুষ দিয়ে প্রতিবারই পার পেয়ে গেছে তারা।
ঠিক এই বিষয়টা নিয়ে কোম্পানিকে চেপে ধরেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। দপ্তরে থাকা ভাউচারগুলো দিয়ে প্রমাণ করা যায়, অবৈধভাবে দস্তক ব্যবহার করে ইংরেজরা প্রায় দেড় কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে- বলেছিলেন নবাব (Sirajuddaulah, English Company and the Palashy Conspiracy- A Reappraisal’, IHR, vol XIII, nos 1-2, July 1986-Jan 1987, page 117)।
আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় পণ্য কিনত স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে; তাদের আগাম টাকা বা 'দাদনি' দিয়ে। ১৭৫৩ সালে এই ব্যবস্থা পাল্টে এল 'গোমস্তা' বা পেইড এজেন্ট পদ্ধতি। তার মানে, যে কোন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আর পণ্য কেনা হবে না, কেনা হবে নিয়োগ করা এজেন্টদের মাধ্যমে। বলাই বাহুল্য, এই গোমস্তা ব্যবস্থা চালুই হয়েছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যবসায় সুবিধা করে দেয়ার জন্য। তাদের পছন্দের গোমস্তারা নিয়োগ পেল, ভাগ জুটল কমিশনের।
ব্রিটিশরা চাপে পড়েছিল
১৭৫০ সালের পর থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি আর ব্যক্তিগত ব্যবসা দুটোই নতুন ঝামেলার মধ্যে পড়ে।
তার আগে অবশ্য ব্রিটিশদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় ভাটা ধরেছিল, ১৭৪০ থেকে। ১৭৫০ এর মধ্যে তাদের ব্যবসা একেবারে খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছিল। ১৭২২ সাল থেকে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসার অনুমতি পাওয়া ফ্রেঞ্চ বনিকরা দাপটের সাথে বাজারের দখল নিয়েছিল।
১৭৩৮ থেকে ১৭৪২ সালে বাংলায় যে সব বণিক জাহাজ এসেছিল, তার একটা তালিকা পাওয়া যায় ভিওসি রেকর্ডে)। সেখানে দেখা যায়-
- ১৭৩৮ সালে
- ১৭৩৯ সালে
- ১৭৪২ সালে
বাংলায় ফ্রেঞ্চ জাহাজ এসেছিল ১৪ টা আর ব্রিটিশ জাহাজ এসেছিল ২৫ টা। এদের মধ্যে কোন সবই ছিল কোম্পানির, ব্যক্তিগত কোন বণিক জাহাজ এখানে ভিড়েনি।
ফ্রেঞ্চ জাহাজ এসেছে ১৬ টা, তার মধ্যে ৯ টাই ব্যক্তিগত। আর ব্রিটিশ জাহাজ এসেছে ২৪ টা, যার মধ্যে ১৮ টা ব্যক্তিগত।
১৮ টা ফ্রেঞ্চ জাহাজ আসে, যার সবগুলোই ব্যক্তিগত। ব্রিটিশ জাহাজ আসে ২৯ টা, যার মধ্যে ২২ টা ব্যক্তিগত।
১৭৫০ সালের পর থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি আর ব্যক্তিগত ব্যবসা দুটোই নতুন ঝামেলার মধ্যে পড়ে। মারাঠা আর বাংলার নবাবের মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়ে যাওয়ার পরে, ফ্রেঞ্চরা নতুন উদ্যমে এখানে যাত্রা শুরু করে। ১৭৫০ এ ঢাকায় ফ্যাক্টরি পর্যন্ত বসিয়ে ফেলে ওরা। বনিকী তৎপরতা শুরু হয় হুগলি, কাশিমবাজার, পাটনা আর ঢাকায়। আর্মেনিয়ান আর এশিয়ান বণিকরাও ভালই দাপট দেখাচ্ছিল সেই সময়।
বাংলার অর্থ ব্যবস্থা সংকটে পড়াতেও ভুগতে হচ্ছিল ব্রিটিশদের। শেঠ'দের কাছ থেকে আর টাকা ঋণ পাচ্ছিল না; উলটো শেঠরা পাওনা টাকা আদায়ে চাপচাপি শুরু করেছিল।
মুখোমুখি সিরাজ
ব্রিটিশ সৈন্যরা কলকাতা পুনর্দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি, দখল করে নিয়েছিল হুগলি'ও।
দস্তক এর অপব্যবহার বন্ধ করতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বেশ কয়েকটি চিঠি পাঠান কলকাতায় ব্রিটিশদের কাছে। পত্রবাহক নারায়ণ সিং এর দুর্ব্যবহারের সংবাদ পেয়ে নবাব দ্রুত পদক্ষেপ নেন; দখল করে নেন কাশিমবাজার ফ্যাক্টরি। এরপরই রওনা হলে কলকাতার দিকে। ইংরেজরা পিছু হটে আশ্রয় নেয় ফুলতা শহরে। সাহায্যের জন্য খবর পাঠায় মাদ্রাজে।
১৩ অক্টোবর ১৭৫৬ সালে মাদ্রাজ ফোর্ট সেন্ট জর্জ এর পক্ষ থেকে ক্লাইভ আর ওয়াটসনের অধীনে সৈন্যবাহিনী পাঠানোর সাথে এই নির্দেশনাও আসে- শুধু কলকাতা আবার দখল করে থেমে থাকলে চলবে না। নবাবের বিরুদ্ধের লোকজনদের সাথেও সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে (Records of Fort St George, Diary and Consultation Books, Military Dept. 1756, page 330)।
ব্রিটিশ সৈন্যরা কলকাতা পুনর্দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি, দখল করে নিয়েছিল হুগলি'ও। এরপর মার্চের প্রথম সপ্তাহে তাদের সাথে যোগ দেয় বোম্বে থেকে আসা ব্রিটিশ সৈন্যরা।
পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭) পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার ক্ষমতা কার্যত নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। তারা নবাবদের নামমাত্র শাসক রেখে রাজস্ব আদায়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়, যা দেওয়ানি ব্যবস্থা নামে পরিচিত। ১৭৬৫ সালে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে দেওয়ানি অধিকার পেয়ে তারা সরাসরি কর সংগ্রহ শুরু করে।
কোম্পানি বাংলার কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ওপর কঠোর কর আরোপ করে এবং তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে নানা আইন প্রণয়ন করে। ধীরে ধীরে বাংলার অর্থনীতি, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, আর স্থানীয় শাসকরা শুধু নামমাত্র অবস্থানে থেকে বাস্তব ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।


