বাংলা নববর্ষের হারানো ১৪ বছর!

image
এই বছর বাংলা সাল হওয়ার কথা ৪৬৮ সাল। কিন্তু এই ১৪ এপ্রিল ২০২৪ এ বাংলা সাল পড়বে ১৪৩১ এ।

সম্রাট আকবরের হাতেই কি শুরু বাংলা নববর্ষের?

যউত্তরটা, হ্যাঁ আবার না।

আজকে আমরা যে বাংলা বর্ষপঞ্জী ব্যবহার করি, সেটা অবশ্যই আকবরের 'তারিখ ই ইলাহি'র অনুসরণ। কিন্তু বাংলা অঞ্চলে বর্ষ গণনার অন্য নিয়ম ছিলো। আকবর সেটাকেই আসলে তার সাল গণনায় অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। যেমন, তারিখ ই ইলাহি'র প্রবর্তন হয়েছিলো ইংরেজি ১৫৮৪ সালে, কার্যকর ধরা হয়েছিলো ইংরেজি ১৫৫৬ সাল, অর্থাৎ আকবরের সিংহাসনে বসার সাল থেকে। আর এখন চলছে ইংরেজি ২০২৪ সাল।

সেই হিসেবে এই বছর বাংলা সাল হওয়ার কথা ৪৬৮ সাল। কিন্তু এই ১৪ এপ্রিল ২০২৪ এ বাংলা সাল পড়বে ১৪৩১ এ।

ফাঁকটা কোথায়?

উল্টো করে হিসেব করা যাক এইবার। ইংরেজি ২০২৪ সাল হল বাংলা ১৪৩১ সাল। তাহলে বাংলা শূন্য সাল কবে? ২০২৪ থেকে ১৪৩১ বিয়োগ করলে পাওয়া যায় ইংরেজি ৫৯৩ সাল।

ঠিক সেই বছরই বাংলার প্রথম স্বাধীন অধিপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন রাজা শশাঙ্ক। তারও আগে এই অঞ্চলে ছিলো 'বিক্রমাদিত্যের' বর্ষপঞ্জী। কিন্তু শশাঙ্ক পাল্টে নিলেন সেটা। তার এই বর্ষপঞ্জী তৈরি হয়েছিলো মূলত সংস্কৃতে লেখা 'সুর্য সিদ্ধান্ত' অনুসারে। আনুমানিক ৪০০- ৫০০ সালে এই বইটির লেখা জানা গেছে ১৪০০ সালের দিকে তালপাতায় লেখা পুথিতে। ১১০০ সালে পার্সি পণ্ডিত আল বিরুনি'র হাতেও এই লেখা পৌঁছায় এবং তার মতে, এটি বিখ্যাত ভারতীয় গণিতজ্ঞ আর্যভট্ট এর ছাত্র লতাদেব এর লেখা।

কিন্তু এর একটা ভিন্নমতও আছে।

যে কারণে, আবার সম্রাট আকবর'র হাতে বাংলা নতুন বছর শুরুও বলা যায়।

কেন? তার আগে জানা দরকার, মুগল শাসক আকবর'কে ঠিক কি কারণে বাংলার ক্যালেন্ডার নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়েছিলো।

সুবা বাংলার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড মানেই কৃষি আর সরকারী কর আদায় করা হত ফসল তোলার সময়ের সাথে মিল রেখে। সেই সময় রাজদরবার অনুসরণ করত ইসলামিক হিজরি সাল। কিন্তু যেহেতু হিজরি সালের গণনার ভিত্তি চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল, সব সময় এর তারিখ ফসল তোলার মৌসুমের সাথে মিলত না। চান্দ্র বছর ছিলো সৌর বছরের তুলনায় ১১ দিন কম। তাই দিন তারিখ ঘোষণা করে কর আদায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেলো।


যেমন, কৃষকেরা তাদের নিজেদের হিসেবে বৈশাখ মাসে বাজারে ফসল নিয়ে যেতো। নির্ধারিত সময়ে কর আদায় না হলে, সরকার যখন কৃষকের কাছে পৌঁছাত, দেখত ততদিনে কৃষকের হাতে আর ফসলও নাই; বিক্রি করে টাকাও খরচ করে ফেলেছে। কি করা যায় তাহলে!

আকবর দায়িত্ব দিলেন জ্যোতির্বিদ ফতুল্লাহ সিরাজি'কে। সিরাজি তখন এই অঞ্চলে প্রচলিত শকাব্দ এর ঐতিহ্যকে অনুসরণ করলেন। সেই অনুযায়ী দিনগুলোর নামও হল সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্রের সাথে মিল রেখে (শনি, রবি, মঙ্গল ইত্যাদি)। সেই বছরে (১৫৮৪ তে) আরবী মাস ছিল ৯৬১। আর সেই আরবী বছরের মুহররম মাস ছিলো বাংলা বৈশাখ মাস। সেভাবেই নতুন করে 'তারিখ ই ইলাহি'কে সমন্বয় করলেন সিরাজি।



বাংলা সাল গণনার ভিত্তি এভাবে তৈরি হলেও, খেয়াল করলে দেখবেন, তারিখ ই ইলাহির মাসগুলোর নাম কিন্তু বাংলা নয়। সেই সময় মাসের নামগুলো তিনি দিয়েছিলেন- ফারওয়ারদীন, আর্দিবিহিশত, খুরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহরীয়ার, মিহির, আবান, আজার, দে, বাহমান ও ইসপন্দর।

তাহলে মাসের নাম পরে ঠিক করল কে? সম্ভবত, তিনি আকবরের নাতি শাহজাহান (১৬২৮- ১৬৫৮)।

তিনি পরে শকাব্দে উল্লেখ করা মাসের সাথে মিলিয়েই আবার নামকরণ করেন। একটু পার্থক্য হয়ে যায় অবশ্যই। বিশাখা হয়ে যায় বৈশাখ, জাইষ্ঠা হয় জ্যৈষ্ঠ। পার্থক্য হল, শকাব্দের প্রথম মাস হল চৈত্র, আর বাংলা সালের প্রথম মাস বৈশাখ।

আর এই অঞ্চলে প্রথম বছরের প্রথম দিনে কর আদায়ের উৎসব 'পুণ্যাহ' চালু করেছিলেন সম্ভবত নবাব মুর্শিদকুলি খান (১৭১৭- ১৭২৭)।



ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক অদ্ভুত তত্ত্ব নিয়ে আসলেন। আকবরের ক্ষমতাগ্রহণের বছর ১৫৫৬ ছিলো হিজরি ৯৬৩ সাল। এরপর থেকে বাংলা সালের বাকি হিসাব। তার মানে, বাংলা সাল = ৯৬৩ + (বর্তমান ইংরেজি বছর - ১৫৫৬)। এভাবেও মিলে যায় অবশ্য।

তার মানে, বর্তমান বাংলা সাল = ৯৬৩ + (২০২৪ - ১৫৫৬) = ৯৬৩ + ৪৬৮ = ১৪৩১

এই যে, ৯৬৩ কে রাখতেই হল, তার ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল।

তার মানে হিজরি শূন্য সাল, বাংলারও শূন্য সাল।

কিন্তু এখন তো হিজরি ১৪৪৫ সাল, আর বাংলায় মোটে ১৪৩১। একসাথে যাত্রা শুরু করে, এমন আলাদা হল কি করে? হল, কারণ হিজরি সালে দিন যে মোটে ৩৫৫ দিন। সৌর বছরের তুলনায় ১১ দিন কম। গত ৪৬৮ বছরে সেই দিন জমে জমে হয়েছে (৪৬৮ * ১১) ৫১৪৮ দিন বা ১৪ বছর।

পড়ে দেখতে পারেন