কাদের আদিবাসী বলবেন?

image
পাহাড়ে তাদের বসবাস, পাহাড়ি প্রকৃতির সাথে তাদের প্রাণ-জীবিকা সম্পর্কিত।

'আদিবাসী' শব্দটি প্রথম এই দেশে ব্যবহৃত হয় ১৯৯৩ সালে। সেই বছর ছিল জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত 'ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিজেনাস ইয়ার'। এরপর ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছরের ৯ আগস্ট পালন করা হয় 'আন্তর্জাতিক ইন্ডিজেনাস ডে'' হিসেবে। এখন পর্যন্ত লেখা বাক্যে সচেতনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে 'ইন্ডিজেনাস' শব্দটি। এখান থেকেই শুরু সেই বিতর্ক।

ইন্ডিজেনাস এর বাংলা কি আদিবাসী হতে পারে? ব্যুতপত্তিপত অর্থ দিয়ে দেখা যাক ব্যাপারটা।

ল্যাটিন বিশেষ্য পদ 'ইন্ডিজেনা' থেকে 'ইন্ডিজেনাস' শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ 'স্থানীয়' (নেটিভ)।

এর দুইটি অংশ- ইন্ডু (Indu), যার মানে ভিতর (in বা within)। আরেকটি অংশ জিগনেরে (gignere), যার মানে উৎপাদন করা।

'ইন্ডিজেনা' মূল থেকে আরেকটা শব্দ আসে, সেটা হল- 'ইন্ডিজেনে' (Indigene)। এর মানে হল নির্দিষ্ট অঞ্চলে জন্মানো ও বড় হওয়া উদ্ভিদ বা প্রাণী।

এসেন্সে, এর অর্থ দাঁড়ায়- একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসরত নেটিভ মানুষেরা।

বাংলা একাডেমির অভিধানে 'আদিবাসী'র অর্থ করা হয়েছে- আদিম জাতি বা অধিবাসী; আসলে এই অর্থটি 'ইন্ডিজেনাস' শব্দের নয়। 'আদিম জাতি বা অধিবাসী' বেশি কার্যকর aboriginal শব্দের অর্থে।

আমাদের দেশে অবাঙ্গালী জাতিগুলো, যারা অনেকদিন ধরে এখানে বাস করছে, প্রকৃতির সাথে সমঞ্জস্য রেখে নিজেদের জীবন গড়ে নিয়েছে, তারা বলছেন- তারা ঐ অঞ্চলের আদিবাসী। কিন্তু বাঙ্গালীদের একতা বড় অংশ সেটা মানতে নারাজ। তারা বলছে, না, তোমরা উপজাতি! উপজাতির ইংরেজি করলে দাঁড়ায় - 'ট্রাইব'।

কেন 'ট্রাইব' শব্দটি আর প্রাসঙ্গিক নয়?

কারণ, এই শব্দের সাথে জড়িত আছে অনগ্রসরতা, আদিমতা এবং পশ্চাৎপদতা। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করা জাতিসত্বাগুলো কোনভাবেই অনগ্রসর নয়, তারা ভিন্ন। পাহাড়ে তাদের বসবাস, পাহাড়ি প্রকৃতির সাথে তাদের প্রাণ-জীবিকা সম্পর্কিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা আগে এসেছে কি পরে এসেছে তার সাথে কোনভাবে 'আদিবাসী' শব্দটি সম্পর্কিত নয়।

কিন্তু 'আদিবাসী' শব্দটার বোধ তৈরি একটু জটিল ব্যাপার। শব্দটি নিয়ে সচেতনতা খোদ পার্বত্য চট্টগ্রামে তৈরি হতে সময় লেগেছে।


পার্বত্য চট্টগ্রামে শব্দটির বোধ

    এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার জন্য 'জুম্ম জাতিসত্তা'র ধারনাটিও প্রচার করা হয়।

বাহাত্তরের সংবিধান তৈরির জন্য যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ এ, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, সংক্ষেপে এম এন লারমা। ২৪ এপ্রিল ১৯৭২ এ গণপরিষদে তিনি চারটি দাবি তুলে ধরেন; এগুলো হল- পার্বত্য চট্টগ্রামের সায়ত্বশাশন, ১৯০০ সালের অনুরূপ রেগুলেশন, উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীদের বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা।

খেয়াল করার মত, ১৯৭২ সালে, এম এন লারমা'র মত নেতা 'উপজাতি' শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে 'উপজাতি' শব্দটির তুচ্ছতা বুঝতে শুরু করে সেখানকার জাতিগুলো। তারা প্রশ্ন তুলে- জাতির আবার 'উপ' কি? সেই সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার জন্য 'জুম্ম জাতিসত্তা'র ধারনাটিও প্রচার করা হয়। জুম চাষ ভিত্তিক জীবন যাদের, তাদের সম্মিলিতভাবে এই নামে ডাকার পক্ষপাতী ছিল অবিভক্ত জনসংহতি সমিতির অনেক নেতাকর্মী।

কিন্তু ১৯৯৭ সালে সন্তু লারমা'র নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে যে 'পার্বত্য শান্তি চুক্তি' সাক্ষরিত হয়, তার 'খ' ধারার প্রথম পয়েন্টটিই হল- "পরিষদের আইনে ব্যবহৃত 'উপজাতি' শব্দটি বলবত থাকিবে"।

যতদূর জানা যায়, সন্তু লারমা সংবিধানে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের’ শব্দসমূহ পরিবর্তন করে `আদিবাসী জাতিসমূহ` শব্দাবলী সংযোজনের দাবি জানিয়েছেন ২০১২ সালের আগস্ট মাসে এসে (https://www.banglanews24.com/cat/news/bd/131453.details)।

এর একটি প্রেক্ষাপটও আছে।



আদিবাসী শব্দ নিয়ে বাঙ্গালী নেতারা

২০০০, ২০০৩, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনেই 'বিশ্ব আদিবাসী দিবসের বাণীতে 'আদিবাসী' শব্দটিই ব্যবহার করেছেন।

২০১০ সালের 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন' আর ২০১১ এর এর পঞ্চদশ সংশোধনীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং 'ক্ষুদ্র জাতিসত্তা'র মত শব্দ প্রথম ব্যবহার করা হয়। সেই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, 'বাঙ্গালিরাই এ দেশের প্রকৃত আদিবাসী' (৭ আগস্ট, সাপ্তাহিক রোববার, ২০১১)। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও বলেন, "পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিস্বত্বার মানুষ আদিবাসী নয়, তারা উপজাতি।" (২ আগস্ট ২০১১, আমাদের সময়) কিন্তু অন্যদিকে আবার আমাদের সরকারের 'আদিবাসী' বলার একটা অভ্যাস কিন্তু ছিলই।

২০০০, ২০০৩, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনেই 'বিশ্ব আদিবাসী দিবসের বাণীতে 'আদিবাসী' শব্দটিই ব্যবহার করেছেন।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অত্যন্ত কঠিন ভাষায় 'আদিবাসী' শব্দকে আক্রমণ করে লেখা লিখেছেন ২০২২ সালের 'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে' (https://surl.li/btrmgm)। তার মতে- "ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর এই 'আদিবাসী' স্বীকৃতির ‘দাবী’ কোনো সাধারণ ও মামুলি ব্যাপার নয়। এর সাথে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা, সরকারের কর্তৃত্ব ও মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত।"

'আদিবাসী' স্বীকৃতি ঠিক কিভাবে এত বড় হুমকি হতে পারে, সেটা অবশ্য তিনি বিস্তারিত বলেননি; তাই বোধগম্যও হচ্ছে না।

এতিনি আরও বলছেন- "'আদিবাসী' জনগোষ্ঠী হিসাবে বিশ্বে যারা সুপরিচিত, যেমন, অস্ট্রেলিয়ার এবরিজিন, যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইন্ডিয়ান, নিউজিল্যান্ডের মাউরি, দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা প্রভৃতি সুপ্রাচীন কাল থেকেই 'আদিবাসী' হিসেবে বিশ্বে সুপরিচিত।"

যদিও তিনি নিজেকে রিসার্চার বলছেন, কিন্তু তার জানা নেই অস্ট্রেলিয়ায় এবরিজিন বা দক্ষিণ আমেরিকায় 'ইনকা' বলে কোন জাতি নেই।

২০২৫ এর জানুয়ারিতে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভিও বলেন, ওরা আদিবাসী হলে আমরা কি পরবাসী? এই শব্দের বিরুদ্ধে খুব নিয়মিত কর্মসুচি পালন করে যাচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ। এরা মূলত পাহাড়ে সেটেলার বাঙ্গালীদের সংগঠন।



সমস্যা কি অনুবাদ নিয়ে?

এই প্রসঙ্গে জাতিসঙ্ঘের নির্দেশনা জেনে নেয়া যাক। 'ইন্ডিজেনাস'দের সাতটি লক্ষণের কথা বলা হয়েছে জাতিসঙ্ঘের সংজ্ঞায়

বাঙ্গালী যে নেতারা 'আদিবাসী' শব্দের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন, তাদের কথায় একটা বিষয় পরিষ্কার- সমস্যাটা তাদের 'আদি' নিয়ে। বাংলাদেশে বাঙ্গালী ছাড়া আর কেউ আদিতে অবস্থান করতে পারে না! তাই অন্য কাউকে আদিবাসী বললে বাঙ্গালীর অবমাননা হয়! মোটামুটি এটাই তাদের সাধারণ বক্তব্য।

তারা কখনো বোঝার চেষ্টা করেন না, এই 'আদিবাসী' শব্দটা যে 'ইন্ডিজেনাস' শব্দের অনুবাদ- সেই মূল শব্দ দিয়ে আসলে কি বোঝানো হচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে জাতিসঙ্ঘের নির্দেশনা জেনে নেয়া যাক। 'ইন্ডিজেনাস'দের সাতটি লক্ষণের কথা বলা হয়েছে জাতিসঙ্ঘের সংজ্ঞায়-

  • নিজেদের ইন্ডিজেনাস মনে করে
  • প্রাক উপনিবেশ যুগ থেকে এই অঞ্চলে তার ইতিহাস আছে
  • ঐ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে তার নিবিড় যোগাযোগ আছে
  • তার সমাজ, অর্থনীতি বা রাজনীতি স্বতন্ত্র ধরণের
  • ভাষা, সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস স্বতন্ত্র ধরণের
  • সমাজে প্রধান ধারা নয়
  • পরিবেশ রক্ষা এবং সমাজব্যবস্থার আদি ধারা বজায় রাখতে চায়

(https://www.un.org/esa/socdev/unpfii/documents/5session_factsheet1.pdf)

এই সবগুলো বিবেচনায় সমতল ও পাহাড়ের অবাঙ্গালী জাতিগুলোকে 'ইন্ডিজেনাস' বলে ডাকতে কারো অসুবিধা থাকার কথা আছে বলে মনে হয় না। যত আপত্তি কেবল ঐ অনুবাদজনিত 'আদি' শব্দটায়!

পড়ে দেখতে পারেন