চীনের এখন বাংলাদেশকে দরকার

image
চীনের মনযোগ বাফার অঞ্চল সম্প্রসারণ নিয়ে। বিশেষ করে ইন্দো প্যাসিফিক সমুদ্র উপকুল যদি সে নিয়ন্ত্রণ হারায়, তবে তার সমুদ্র বাণিজ্য হুমকির মধ্যে পড়বে।

গত দুই দশক ধরে চীন খুব করে চাইছে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে তুলতে। তাদের সে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে, সামরিক চুক্তি করছে, বাস্তবায়ন করছে বড় মাপের অবকাঠামো প্রজেক্ট।

ভারত সহ পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে এই সবই চীনের চাল।

বড় বড় সব অবকাঠামো আসলে কোন কাজেই আসে না দেশগুলোর। আসলে চীন চাইছে, ঋণের ফাঁদে বেঁধে ফেলে এদের নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে; আর সীমিত করে আনতে চায় এই অঞ্চলে ভারতের কতৃত্ব। এইভাবে দেখলে হয়ত খুব সরলীকরণ হয়।

ভেবে দেখা দরকার ১৯৪০ এর দশকে বিপ্লবের পরে চীন কিভাবে আজকের অবস্থানে এল।


ভারত অংক

  • প্রতিবেশী দেশগুলো যে ভারতের খবরদারিতে বিরক্ত, সেটা নতুন তথ্য নয়।

ভারত, দক্ষিণ এশিয়ার বড় শক্তি। বিপুল তার আয়তন, বিপুল তার জনসংখ্যা। এই অঞ্চলের প্রায় সব দেশের সাথে তার সীমান্ত। ১৯৮০ সালেও দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে ভারতের অংশ ছিল ৭৬ ভাগ। এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ ভাগে।

এটা এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্যে নিঃসন্দেহে এক বড় অসঙ্গতি।

১৯৬১ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাদের নীতি উচ্চারন করেছেন স্পষ্টভাবেই। দক্ষিণ এশিয়ায় কোন বাইরের শক্তির অনুপ্রবেশ ভারত সহ্য করবে না, বিশেষ করে তা যদি হয় ভারতের স্বার্থ বিরোধী।

ভারত মনেই করে, তাকে ছাড়া কোন আঞ্চলিক সহযোগিতা হতে পারে না। সামরিক শক্তি দিয়ে এখানে শান্তি বজায় রাখার সক্ষমতা তার আছে বলে সে মনে করে।



ভারত থেকে মুখ ফেরানোর কাল

ভারতের এই মনোভাব চ্যালেঞ্জড হয়েছে নানা ভাবেই।

এক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান ছিল পাকিস্তানের। সে চেয়েছিল ভারতের সাথে সমতার সম্পর্ক। সেই লক্ষ্যে পাকিস্তান সহায়তা নিয়েছে আমেরিকা, চীন, মধ্যপ্রাচ্য আর তুরস্কের। এই মনোভাব আছে অন্যান্য দেশেরও।

স্বাধীনতার পরপরই ভারতের আগ্রাসন ঠেকাতে ব্রিটেনের সাথে সামরিক চুক্তি করেছিল শ্রীলংকা; পরে ঝুকেছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের দিকে। ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট জয়াবর্ধনে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন আমেরিকার।

ভারত’ও বসে থাকেনি। সে আশ্রয় প্রশ্রয় দিতে শুরু করল তামিল বিদ্রোহী গ্রুপদের। তাতেও কাজ না হওয়ায় ১৯৮৭ সালে নিজেই নেমে পড়েছিল মাঠে।

এরপর পর পর কয়েকটি ভারতপন্থী সরকার এলেও এখনও তার ঘনিষ্ঠতা চীনের সাথে।

মালদ্বীপ আর চীনের ঘনিষ্ঠতাও দেখছে উদ্বেগের সাথে। চীনা ব্যাংক থেকে দেশটি প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার ধার করেছে। ২০১৪ সালে চীন চালু করে ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI); এর আওতায় মালদ্বিপে অনেক অবকাঠামো নির্মান করেছে চীন। ২০২৩ এ ভারতপন্থী মোহাম্মেদ সলিহ’র বিদায়ের পরে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু শুরু করেন ‘ভারত খেদাও’ আন্দোলন।

ক্ষমতায় এসেই মুইজ্জু ভারত’কে বললেন, তার সামরিক সদস্যদের এখান থেকে ফিরিয়ে নিতে। ভারত সফরের আগে গেলেন চীন সফরে। বদলা হিসেবে মালদ্বীপের লক্ষ্যদ্বীপের কাছে মিনিকয় দ্বীপে গরে তুলল নেভাল বেইজ। আর লক্ষ্যদ্বীপে হঠাত করেই বেড়ে গেছে ভারতীয় পর্যটকদের আনাগোনা।

মুইজ্জু কিন্তু নিছক ভারত বিরোধিতায় মাতেননি, বরং চীন’কে দিয়ে ভারতকে ব্যালেন্স করা চেষ্টা করেছেন। ফলে, মোদি’র ‘নেইগবারহুড ফার্স্ট’ নীতির অংশ হিসেব রয়ে গেছে মালদ্বীপ; আদায় করে নিয়েছে শত কোটি ডলারের আর্থিক সহযোগিতা।

দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভুটান, এখনো চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। দেশটিকে বলা হয়, ভারতের স্যাটেলাইট ষ্টেট। অথচ চীনের সাথে ভুটানের প্রায় ৪৭৭ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।



একই ব্যাপার বাংলাদেশেরও।

একদিকে ভারতের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে চীনের কৌশলগত অবস্থান- এই দুইয়ে মিলে দক্ষিণ এশিয়ার পাওয়ার ডিনামিক্স বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে।

নদী নিয়ে বিরোধ, বাণিজ্যে ঘাটতি, সীমান্তে হত্যা আর আওয়ামী লীগ’র সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন- এই সবের কারণে ভারত এখানে খুবই অজনপ্রিয়। আর ৫ আগস্টে পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'কে আশ্রয় আর নিরাপত্তা দিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে ফেলেছে ভারত। এখনকার সরকারকে নিয়ে তাঁর ভয়, এরা ইসলামী চিন্তার দলগুলোকে প্রশ্রয় দিতে পারে। ভারত'কে আরও চিন্তায় ফেলে ইতোমধ্যে জামাত ই ইসলামী সহ বেশ কিছু ইসলামী দলের নেতারা চীন সফর করে এসেছে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে।

ফলে, একদিকে ভারতের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে চীনের কৌশলগত অবস্থান- এই দুইয়ে মিলে দক্ষিণ এশিয়ার পাওয়ার ডিনামিক্স বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। এই সেইদিনও চীন ছিল কেবল ‘সস্তা শ্রমের কারখানা’; হয়ে উঠল আধুনিক প্রযুক্তিতে দুনিয়ার এক নম্বর দেশ। তার অর্থনীতি মজবুত, কুটনীতির ভিত্তি শক্ত।

এখন তার চ্যালেঞ্জ প্রতিরক্ষা। কেননা, তার বিরুদ্ধে প্রায় সব বড় শক্তি এককাট্টা। গত পাঁচ বছরে গড়ে উঠেছে নানা জোট- কোয়াড ( Quad- ইন্ডিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও আমেরিকা), AUKUS (অস্ট্রেলিয়া, ইউকে ও ইউ এস), Five Eyes (আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউকে, নিউ জিল্যান্ড, আর কানাডা)। সবগুলো জোটের সাধারণ লক্ষ্য চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সামরিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা।

'তাই চীনের মনযোগ বাফার অঞ্চল সম্প্রসারণ নিয়ে। বিশেষ করে ইন্দো প্যাসিফিক সমুদ্র উপকুল যদি সে নিয়ন্ত্রণ হারায়, তবে তার সমুদ্র বাণিজ্য হুমকির মধ্যে পড়বে।

সেই জন্যই চীন বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালায়শিয়ার মত দেশগুলোকে। মানচিত্রে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এগুলো সবই সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ।

এই সমীকরণেই বাংলাদেশ গুরুত্বপুর্ণ চীনের কাছে।

বাংলাদেশকে তার পক্ষে রাখতে হলে, এই দেশে তার চাই ভারতবিরোধী মনোভাবের বিস্তার।

অন্যদিকে চীনের এই সব মতলব বুঝে, ভারতের দরকার ছিল বাংলাদেশের সাথে সমঝোতামূলক সম্পর্ক। কিন্তু তা না করে, এখনো সে আছে বড়ভাই সুলভ ধমকের সম্পর্কে।

তাই এখন বাংলাদেশের সাথে চীন যে আরও ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

পড়ে দেখতে পারেন