রোহিঙ্গা আর রাখাইনে নতুন দিন!

image
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত সামরিক জান্তার সৈন্যরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ইস্যু কি সমাধানের আলো দেখতে পাচ্ছে?

বাংলাদেশে হাসিনা সরকার উচ্ছেদ হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত সামরিক জান্তার সৈন্যরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ইস্যু কি সমাধানের আলো দেখতে পাচ্ছে? না কি আরও জটিল হয়ে উঠছে সবকিছু? বলা মুশকিল।

সেই ১৯৭০ এর দশক থেকে রোহিঙ্গা সমস‍্যা টেনে চলেছে বাংলাদেশ। তাই সমস্যা সমাধানে তার উদগ্রীব হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এর মধ্যে বাংলাদেশ এক কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে।

২০২৪ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি রেজোলিউশন পাশ করিয়ে নিয়েছে সে- ২০২৫ এ উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক আয়োজন হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ইস্যুতে। এটা অনুষ্ঠিত হতে পারে এই বছরের সেপ্টেম্বরে বা অক্টোবরে। প্রস্তুতি শেষ হবে এপ্রিলের মধ‍্যে। ভেন‍্যু হিসেবে এসেছে বাংলাদেশ বা কাতারের নাম। কিন্তু কি ঘটবে এই বৈঠকে?

বাংলাদেশ'র চাওয়া একটাই। তার ভাষায়- স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আর মর্যাদা নিয়ে মিয়ানমারে প্রত্যার্পন। কিন্তু চাইলেই কি ঘটবে এই প্রত্যার্পন?

মিয়ানমারেও ইতোমধ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে চলেছে। নভেম্বর ২০২৩ থেকে রাখাইন রাজ্যের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে আরাকান আর্মি। যে অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল, সেটাও এখন আরাকান আর্মির দখলে।

শেখ হাসিনা'র সরকার আরাকান আর্মির উত্থানটা ভাল করে খেয়াল করে উঠতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশে এখন কথা উঠেছে, আরাকান আর্মির সাথে আলোচনা শুরু করা দরকার।

রোহিঙ্গা সমস্যা যতদিন কেবল বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সমস্যা, ততদিন এর আন্তর্জাতিক সমাধান মুশকিল। এটি যে একটি জাতিগোষ্ঠীর প্রতি দীর্ঘদিন ধরে চলা আগ্রাসন আর আক্রমণের ফল, এটি না বুঝলে নিরাপদ আর মর্যাদাপুর্ন প্রত্যার্পন প্রায় অসম্ভব।


রোহিঙ্গারা কি শুধু বাংলাদেশে?

  • 'ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস' এর সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে দেখা যায়-
  • সারা পৃথিবীতে ২৮ লক্ষ রোহিঙ্গা আছে; এদের মধ্যে মাত্র ২৩% নিজ দেশ মিয়ানমারে অবশিষ্ট আছে। কতটা অন্যায় জবরদস্তি থাকলে একটা জনগোষ্ঠীর ৭৭% মানুষকে দেশ থেকে বের করে দেয়া যায়!

মিয়ানমার বাদ দিলে, বাংলাদেশেই আছে প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা। পাকিস্তানে আছে ৪ লক্ষ, সৌদি আরবে সাড়ে ৩ লাখ আর মালায়শিয়া'তে ২ লক্ষ ১০ হাজার।

সব দেশে রোহিঙ্গারা এক রকম নেই।

সৌদি আরব আর পাকিস্তানে ওরা গেছে বহু বছর আগে; তাদের বাচ্চাকাচ্চারা কখনোই স্বদেশের মুখ দেখেনি। গত ৫ বছরে যারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল, তাদের মধ্যে ৭৬%ই আবার ফিরে যেতে চায় মিয়ানমারে। আর যারা ২০ বছরের বেশি সময় বিদেশে কাটিয়েছে, তাদের মাত্র ২৮% ফিরার ব্যাপারে আগ্রহী। তাই কেবল গড়ে সব রোহিঙ্গাকে ফেরানোটাই হয়ত সমাধান নয়।

বাংলাদেশে যে সব রোহিঙ্গা আছে, তাদের বড় অংশই এখানে আস্তে শুরু করেছে ২০১৬-১৭ সালের দিকে। ফলে, তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোতেই ঢাকা'র মনযোগ বেশি। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, চটজলদি সমাধানের চাপ অনেক সময়ই কাজ করে না; বরং উল্টো ফল দেয়। ১৯৭০ এও দেখা গেছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের তুলে পাঠানো ফ্লাইট ঘুরে আবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল। সংকটের গোড়ায় হাত না দিয়ে কেবল ফেরত পাঠানোর চাপ কোন ফলাফল ব্যয়ে নাও আনতে পারে।

গোড়াটা কোথায়?

এক কথায় বললে, গোড়াটা মিয়ানমারে, আরও স্পষ্ট করে বললে আরাকান রাজ্যে।

আভ্যন্তরীণ ফয়সালা না করে কেবল মিয়ানমার আর বাংলাদেশ দুই রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বসলে সংকটের সমাধান হবে না। কারণ, নামে এখনো মিয়ানমারের সরকারে আছে সামরিক জান্তার ষ্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি); কিন্তু দেশের বড় অংশের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সে। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে সামরিক জান্তার বাহিনীর কার্যত কোন অবস্থানই আর অবশিষ্ট নেই।

'ষ্টেট-সেন্ট্রিক' উদ্যোগ কাজে না আসার উদাহরণও রয়েছে।

২০১৭ থেকে বাংলাদেশ থেকে শরনার্থী প্রত্যাহার বিষয়ে চীন অনেকবার দূতিয়ালির উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা বা রাখাইন'কে যুক্ত না করে নেয়া সেই সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবার।

২০২১ সালে মিলিটারি ক্যু এর পরে শরনার্থী প্রত্যাহার আর শুরু করাই যায়নি।

আন্তর্জাতিক সমাজ যদি আরাকান আর্মির দখল'কে স্বীকৃতি না দেয়, তবে শরনার্থী বিষয়ক আলোচনা এগুনোর কোন সুযোগ নেই। কিন্তু এদিকে আরকান আর্মি সেই অর্থে স্বীকৃত কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি নয়। এই নিয়ে দোলাচলে দীর্ঘায়িত হয়ে চলেছে সংকট ।



আরাকান আর্মি'ও রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসেনি

আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে তাদের ফিরিয়ে নিবে মিয়ানমার, এই মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল সেই সব রোহিঙ্গাকে। আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গারা এভাবে হয়ে দাঁড়াল বিপক্ষের মানুষ।

১৬ মার্চ, গত বছরটা রাখাইনের জন্য ভাল যায়নি একদমই। যদিও আরাকান আর্মি, সরকারি সামরিক বাহিনীকে সম্পুর্ণভাবে পরাজিত করে হটিয়ে দিয়েছে, রাজ্যে স্বস্তি আসেনি পুরোপুরি।

নভেম্বর ২০২৩ এ শেষ পর্যায়ের যুদ্ধের পরে রাখাইন রাজ্য ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। সামরিক জান্তা রাজ্যটিকে সর্বাত্মক অবরোধের মধ্যে রাখার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন পণ্য এখানে ঢুকতে পারছে না।

দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। মানুষের হাতে টাকাও নেই।

জাতিসংঘ সাবধান করেছে, দুর্ভিক্ষ আসন্ন।

রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যাল্ভেশন আর্মিসহ নানা সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপে সরাসরি যোগান দিয়েছে অস্ত্র আর টাকা।

অথচ ২০২২ এও পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। রাখাইন আর রোহিঙ্গাদের মধ্যে সদ্ভাব ছিল। ২০২২ এ অনেক বছর পরে আবার রোহিঙ্গা ছাত্ররা আরাকান রাজ্যের রাজধানী সিত্তুয়ে'র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল।

কিন্তু জান্তার বুদ্ধি ভয়ংকর।

কক্সবাজারের রেফিউজি ক্যাম্পে অনেক তরুণকে রিক্রুট করে জোর করে সীমান্ত পেরিয়ে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী। রয়টারের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংখ্যাটা ৩ থেকে ৫ হাজারের মধ্যে। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে তাদের ফিরিয়ে নিবে মিয়ানমার, এই মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল সেই সব রোহিঙ্গাকে। আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গারা এভাবে হয়ে দাঁড়াল বিপক্ষের মানুষ।

আরাকান আর্মির অনেকে মনে করে, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা সৈন্য অনুপ্রবেশ করে যুদ্ধ করার পিছনে বাংলাদেশ সরকারের হাত থাকতে পারে।



তাহলে করণীয় কি?

রাখাইন রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে আরাকান আর্মিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়ত একটা পথ।

এই বছর সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৈঠকের আগেই কিছু পদক্ষেপ নেয়া বাংলাদেশের জন্য জরুরী। কি হতে পারে?

রাখাইন রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে আরাকান আর্মিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়ত একটা পথ। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য উদাহরণ দাঁড় করিয়েই রেখেছে চীন ও থাইল্যান্ড। তারা নিজেদের সীমানায় যে সব বিদ্রোহীরা শক্তিশালী হয়েছে, তাদের সাথে আলোচনায় বসে নানা ইস্যু সমাধান করে নিচ্ছে। তবে এখনো একটা বিষয় স্পষ্ট না।

রাখাইনে ঠিক কি ধরণের নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে? মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় শাসনে রাজ্য হিসেবে থাকবে না কি হবে কনফেডারেশনের অংশ, সেটা এখনো সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। যদ্দুর বোঝা যাচ্ছে, স্বায়ত্বশাসনের জন্য সক্ষমতা অর্জনে আরাকান আর্মি আর ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকান কাজ করে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় আরেকটি করণীয়, যেটি সবচেয়ে কঠিন, ভারত আর চীন দুই পক্ষকে সমানভাবে ম্যানেজ করা। দুই দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ ভালই জড়িয়ে আছে রাখাইন ষ্টেটে। ভারতের আছে করিডোর, চীনের আছে ইপিজেড। এদের বাদ দিয়েও কূটনৈতিক সফল্য আনা বাংলাদেশের জন্য মুশকিল হওয়াই স্বাভাবিক।


FRONTIER এ Laetitia Van Den Assum এর লেখা অবলম্বনে

পড়ে দেখতে পারেন