১৯৭১ এর মার্চঃ কি করছিল বামপন্থীরা?

image
১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ। একটা বাঁক পরিবর্তনের মাস। সেই সময়টায় কি করেছিল বামপন্থী দলগুলো? কি ছিল তাদের বক্তব্য, কি ছিল ক্রিয়া?

মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক। এই লেখা সেই বিষয়ে নয়; এর উদ্দেশ্য ভিন্ন- একটু মাইক্রো লেভেলে দেখতে চাওয়া।

মার্চ ১৯৭১। দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল অনিবার্য স্বাধীনতার দিকে।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম'র 'একাত্তরের দিনগুলি' বইয়ের শুরুটাই সেই ১ মার্চ দিয়ে। স্টেডিয়ামে চলছিল আন্তর্জাতিক একাদশ বনাম বিসিসিপি একাদশের মধ্যে টেস্ট ম্যাচ। রেডিওতে শোনা গেল, অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত। ক্রিকেট ম্যাচ পণ্ড করে দলে দলে মানুষ বেরিয়ে এসেছিল রাস্তায়।

সেই শুরু। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ। একটা বাঁক পরিবর্তনের মাস।

সেই সময়টায় কি করেছিল বামপন্থী দলগুলো? কি ছিল তাদের বক্তব্য, কি ছিল ক্রিয়া? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হয়েছে সেই সময়ের নানাজনের স্মৃতিকথায় আর সংবাদপত্র থেকে। এর বাইরেও তথ্য থাকতে পারে; পেলে সেগুলো সাদরে গ্রহণ করতে কোন সমস্যা নেই।


১৯৭১ এর মার্চ মাসে সক্রিয় বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে যাদের নাম জানা যায়-

  • ১। বারীন দত্ত'র নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি
  • ২। সুখেন্দু দস্তিদার আর তোহা'র নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল)
  • ৩। দেবেন শিকদার'র নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি
  • ৪। সিরাজ সিকদার'র নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন
  • ৫। নির্মল সেন'র নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল
  • ৬। রাশেদ খান মেনন ও রনো'র নেতৃত্বে 'কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি'।

১ মার্চ- ৭ মার্চ

১ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে শেখ মুজিব বললেন, সবার সাথে আলোচনা করে ৭ মার্চ তিনি পূর্নাঙ্গ কর্মসুচী ঘোষণা করবেন (দৈনিক পাকিস্তান, ২ মার্চ)। ঐদিন সন্ধ্যায়ই তার বৈঠক হয়েছিল মোজাফফর আহমদ'র সাথে।

একই দিনে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি'র ছাত্র সংগঠন পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন'র সভাপতি জুনো আর সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান'র বিবৃতিতে দেখা যায়- "প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় আমরা অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর মত বিস্মিত হইনি।" এতে মনে হতে পারে, সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি তাদের কাছে খুবই পরিষ্কার। সমন্বয় কমিটি'র তরফ থেকে পরপর তিনটি লিফলেট ছাপা হয় লাল হরফে (এক জীবন, রাশেদ খান মেনন, ৩৫৫)।

২ মার্চ সিরাজ সিকদার'র 'পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন'র পক্ষ থেকে একটি লিফলেট বিলি করা হয়। এর শিরোণাম ছিল- শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের খোলা চিঠি।

এতে বলা হয়, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন ও মুক্ত করেই ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবিগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব। পূর্ব বাংলার ওপর পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে 'স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র' কায়েমের জন্যই সাত কোটি মানুষ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। এই আহ্বানের সাথে যোগ হয় ১৩ দফা কর্মসুচী- স্বাধীন গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ন, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কর্মসুচী। কিন্তু এই কর্মসুচী নিয়ে তারা কখনো আওয়ামী লীগের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে বলে জানা যায়নি (লাল সন্ত্রাস, মহিউদ্দিন আহমেদ, ৭০)।

২ মার্চ, মস্কোপন্থী ন্যাপ হরতালের মধ্যে জনসভা করে পল্টনে। এখানে ঐক্যবদ্ধ কর্মসুচীর উপর জোর দেয়া হয় (দৈনিক পাকিস্তান, ৩ মার্চ)।

মাওলানা ভাসানি ২ মার্চ ঢাকায় এসে দুই দিন থাকেন, ৪ তারিখে ফিরে যান টাঙ্গাইলের সন্তোষে। যাওয়ার আগে তিনি যে বিবৃতি দেন, তাতে ছিল- "আমি কংগ্রেস, খিলাফত, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মাধ্যমে আন্দোলন করেছি। কিন্তু আমার ৮৯ বছর বয়সে এবারকার মত গণজাগরণ এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক ঘোষণার বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ বিক্ষোভ আর দেখিনি। জনগণের এই স্বতস্ফুর্ত ও নজিরবিহীন আত্মচেতনা এবং পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার দৃঢ় সংকল্পের জন্য তিনি জনসাধারণের প্রতি মোবারকবাদ জানান (দৈনিক পাকিস্তান, ৫ মার্চ)।"

৪ মার্চ, শহীদ মিনারে ছাত্র সমাবেশ করে পূর্ব পাকিস্তন ছাত্র ইউনিয়ন। এখানে মতিয়া চৌধুরী বলেন, এবারের আন্দোলন মেহনতি মানুষের সার্বিক মুক্তির আন্দোলন। এই দিন থেকে শহিদ মিনারে টানা ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচী চলছিল। এর নাম দিয়েছিলেন তারা- স্বাধিকার আন্দোলন।

৬ মার্চ ঢাকা নিউমার্কেট মোড়ে বক্তব্য রাখছেন ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ (সূত্রঃ দৈনিক সংবাদ, ৭ মার্চ ১৯৭১)

৬ মার্চ, নিউ মার্কেট মোড়ে সকালে সমাবেশ করে ন্যাপ (ওয়ালি)। এখানে মোজাফফর আহমদ জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন-
"জানি না, আপনারা ৬ দফায় খুশি হবেন কি না। আমি বলব, ৬ দফার জন্য নয়, তারা (শহীদেরা) ১ দফার জন্যই জীবন উতসর্গ করেছেন। আমরা গরীব ও মজলুমের পার্টি। আমাদের পার্টি যতই ক্ষুদ্র হোক, আমরা অন্য কারো বাণীর জন্য বা বাণীর সমর্থনে নয়, শহীদানের বাণীর জন্য সংগ্রাম করে যাব (দৈনিক সংবাদ, ৭ মার্চ)। একই সভায় মতিয়া চৌধুরী কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ পয়েন্ট বলেন- "আজ শুধু ৬ দফা ১১ দফা দিলেই চলবে না, তাতে বাঙ্গালীসহ প্রত্যেকটি জাতির স্বাধীন হওয়ার অধিকারের কথা পরিষ্কারভাবে স্বীকার করতে হবে।… আর এক জাতিতত্বের নামে শোষণ-নিপীড়ন নয়- বাংলাসহ প্রত্যেকটি ভাষাভাষী জাতির জাতিসত্তা স্বীকার করতে হবে (ঐ)।

মধ্যপ্রাচ্যে আছে প্রায় ডজনখানেক নদী; এদের বেশিরভাগই আকারে ছোট। নদী বলতে কেবল বলা যায় ইউফ্রেটিস , টাইগ্রিস আর জর্ডান নদীর নাম।

৭ মার্চ - ১৫ মার্চ

৭ মার্চের পরে একেবারেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। স্বাধীনতার দাবি খুব স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হতে থাকে সব জায়গায়। সেই সময় বামপন্থীরাও নিজস্ব বক্তব্য নিয়ে কর্মসুচী পালন করতে শুরু করে।

৭ মার্চের জনসভায় উপস্থিত ছিলেন নির্মল সেন'ও। তার মনে হয়েছিল, শেখ সাহেবের পিছু হটবার পথ নেই। আজ হোক বা কাল হোক, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই এবং সে সংগ্রাম হবে রক্তাক্ত। দীর্ঘস্থায়ী। আমি তখন কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এ যুদ্ধে কে সাহায্য করবে! কাছাকাছি কোন সমাজতান্ত্রিক দেশ নেই। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক গভীর। পাশে ভারত। এটি একটি পুঁজিবাদী দেশ (আমার জবানবন্দী, নির্মল সেন, ২৯২)।

৯ মার্চ, তিনি কাকীর অসুস্থতার কথা শুনে বাড়ি যান। সেখানে ছিলেন ২৫ মার্চ পর্যন্ত। ক্র্যাকডাউনের খবর পেয়েছেন সেখানেই। তাঁর নিজের ভাষায়- 'আজ বলতে দ্বিধা নেই, ২৫ মার্চ এমন করে সংকটের গভীরতা বুঝতে পারিনি। আমার কাছে প্রশ্ন ছিল, এ যুদ্ধ জিতব কী করে- এ যুদ্ধে কে আমাদের সাহায্য করবে বা কেন করবে ( ঐ, ২৯৩)।

৭ মার্চ এর ভাষণ সম্পর্কে সেই সময়ের ছাত্র ইয়নিয়ন নেতা মঞ্জুরুল আহসান খান লিখেছেন, "একদিকে শর্তসাপেক্ষে আপস আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত, অপরদিকে আন্দোলন-সংগ্রামকে আরও বিকশিত ও তীব্র করা; এমনকি স্বাধীনতার লক্ষ্যকে উচ্চারণ করা, এই দুই কৌশল আমার কাছে অনেকটাই অভিনব বলে মনে হয়েছিল (বলা না বলা কথা, মঞ্জুরুল আহসান খান, ৩৪)।

৮ মার্চ ছাত্র ইউনিয়ন তার কর্মী বাহিনীর জন্য রাইফেল ট্রেনিং ও কুচকাওয়াজের আয়োজন করে। এই ট্রেনিং চলে ২০ মার্চ পর্যন্ত।

মার্চের শুরুতেই, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) একটি গোপন সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। এটি সম্পাদনা করেন বদরুদ্দিন উমর। পত্রিকার নাম হয় 'মুক্তিযুদ্ধ'। ৮ মার্চ এখানে একটি আবেদন ছাপা হয়-

'মুক্তিযুদ্ধ জোরদার করুনঃ পূর্ব বাংলার শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী ও ধনিকদের প্রতি কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী ) আবেদন'।

এখানে বলা হয়েছে- 'শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ হল দেশের শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধি। গ্রামাঞ্চলে তাদের শক্তি হল জোতদার-মহাজন। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব পূর্ব বাংলার বাজার লুটপাট ও ক্ষমতার ভাগাভাগির দ্বন্দ্ব (বামপন্থার সুরতহাল, মহিউদ্দিন আহমেদ, ১৫৫)। আর শেষ হয়েছে এইভাবে-

  • "সশস্ত্র কৃষি বিপ্লব জিন্দাবাদ! কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রামের লাল আগুন ছড়াইয়া দাও! মার্কিন দস্যুদের হটাও! মার্কিনের পা-চাটা জোতদার-মহাজন-ধনিকদের খতম কর! জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েম কর! পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী- লেনিনবাদী) জিন্দাবাদ!" (বামপন্থার সুরতহাল, মহিউদ্দিন আহমেদ, ১৮৩)।

৯ মার্চ পল্টনের জনসভায় মাওলানা ভাসানি অবিলম্বে সাত কোটি বাঙ্গালীকে স্বাধীনতা দানের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আগামী ২৫ মার্চের মধ্যে এই দাবি মেনে না নিলে তিনি শেখ মুজিবের সাথে এক হয়ে বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করবেন (দৈনিক পাকিস্তান, ১০ মার্চ)। ভাসানি সেই সময় জেলায় জেলায় সমাবেশ করে যাচ্ছিলেন। এইদিন ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী এক বিবৃতিতে রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান কতৃক উত্থাপিত দাবিসমূহ অর্জন পূর্ব বাংলার জনগণ ও ছাত্র সমাজের আশু লক্ষ্য বলে বর্ননা করেন এবং এই দাবি আদায়ের জন্য এক বৃহত্তর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান (দৈনিক সংবাদ, ১০ মার্চ)।

৯ মার্চ পল্টন ময়দানে বক্তব্য রাখছেন মাওলানা ভাসানি (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ মার্চ ১৯৭১ )

৯ মার্চ তারিখেই পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক প্রস্তাব প্রকাশিত হয়। এর শিরোনাম ছিল- "শত্রু বাহিনীকে মোকাবিলায় প্রস্তুত হউন; গণস্বার্থে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন" (কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস প্রসঙ্গ ও দলিলপত্র, নূহ আলম লেনিন, ৬৩৩)। এখানে শুধু জনগণকে লড়াইতে আহ্বান করা হয়নি, অপরাপর কমিউনিস্টদের বিভ্রান্তি থেকে সতর্ক থাকতেও বলা হয়েছে।

তারা লিখেছেন- "কতগুলো তথাকথিত "কমিউনিস্ট পার্টি" জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য 'ধর্মঘট, অসহযোগ আন্দোলন ইত্যাদির প্রয়োজন নাই', 'গ্রামে গ্রামে কৃষি বিপ্লব শুরু কর', 'জোতদারদের গলা কাট', প্রভৃতি আওয়াজ তুলিতেছে। কোন কোন নেতা 'স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা হইয়া গিয়াছে' বলিয়া ধ্বনি তুলিয়া আজিকার গণসংরামের সংকল্প ও প্রস্তুতিতে ভাটা আনিয়া দিতে চাহিতেছেন।"

আরও লিখেছেন- "কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশে এমন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের আহ্বান জানাইতেছে যেখানে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ উৎখাত করিয়া ও পুঁজিবাদী বিকাশের পথ পরিহার করিয়া জনগণের স্বার্থে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করা ও সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হইবার বিপ্লবী পথ উন্মুক্ত হইতে পারে (ঐ, ৬৩৪)।

ঐ একই দিনে প্রকাশিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) এর ঢাকা জেলা কমিটির নামে লিফলেট। এখানে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে প্রথমে গ্রামে কৃষকদের গেরিলা যুদ্ধ শুরু করার আহ্বান জানানো হয় (আমার জীবন ৩য় খণ্ড, বদরুদ্দিন উমর, পৃষ্ঠা ১৪৭)।

১০ মার্চ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের 'স্বাধিকার আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম দিন' এর কর্মসুচী শুরু হয়। শহিদ মিনার থেকে খণ্ড মিছিল বের হয় আর ট্রাকে করে ঘোরে গণসংগীত স্কোয়াড। একই দিনে ঢাকায় নিউ মার্কেটে ন্যাপ (মোজাফফর) পথসভা করে এবং ময়মনসিংহে জেলা ন্যাপের জনসভায় মুক্তি সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয় (দৈনিক সংবাদ, ১১ মার্চ)।

১১ মার্চ ন্যাপ (মোজাফফর) এর পথসভা হয় বায়তুল মোকাররমে। এখানে তিনি বলেন, "শুধু স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমেই বাংলাকে সার্বিক শোষণমুক্ত করা যাবে না। আজ একই সঙ্গে আমাদের সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির শোষণ চিরতরে উৎখাতের লড়াইও চালিয়ে যেতে হবে (দৈনিক সংবাদ, ১২ মার্চ)।

এই দিন ন্যাপ (মোজাফফর) প্রধানের দেশব্যপী সফরসুচী ঘোষণা করা হয়। কুমিল্লায় দুটি আর নোয়াখালীতে একটি সভা করার কথা কর্মসুচিতে ছিল (ঐ)।

১১ মার্চ টাঙাইলে আর ১২ মার্চ ময়মনসিংহে ন্যাপ (ভাসানি)'র জনসভায় জমায়েত হয় হাজারো মানুষ। ময়মনসিংহের জনসভায়, শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সাথে আপোষ করতে পারে বলে যে গুজব রটানো হচ্ছে, তাতে বিশ্বাস করে শেখ মুজিবের উপর আস্থা না হারানোর জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান (দৈনিক পাকিস্তান, ১৩ মার্চ)।

১২ মার্চ মস্কোপন্থী ন্যাপের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা থেকে পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়- "জনগণকে আজ মনে রাখতে হবে এই সংগ্রাম হল গণবিরোধী শোষকের বিরুদ্ধে- ২২ পরিবার, জায়গীরদার, জোতদার ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। এই তিন শত্রুকে খতম করেই বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। এ কারণে বাঙ্গালীর দাবির প্রতি সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান, প্রভৃতি জাতির সমর্থন প্রয়োজন… পশ্চিম পাকিস্তানের শোষিত জনগণ ও জাতিগুলোর প্রতি একই শ্রেণী শত্রুকে খতম করে নিজ নিজ ভূখণ্ডে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করার আহ্বান জানানো হয়" (দৈনিক পাকিস্তান, ১৩ মার্চ)।

১২ মার্চ সদরঘাটে পথসভায় বক্তব্য রাখছেন মতিয়া চৌধুরী (সূত্রঃ দৈনিক সংবাদ, ১৩ মার্চ ১৯৭১ )

১২ মার্চ সদরঘাট থেকে ন্যাপ (মোজাফফর) এর পথসভা শুরু হয়, এবং পরে একটি মিছিল সহ আরও ৪ টি পয়েন্টে তারা পথসভা করে (দৈনিক সংবাদ, ১৩ মার্চ)। এখানে বলা হয়- "যে একদফা- শোষণমুক্ত বাংলার সংগ্রামে সাত কোটি নরনারী লিপ্ত হয়েছে, তা কোন শক্তিই রোধ করতে পারবে না।"

১৩ মার্চ, ভৈরবে ভাসানি জনসভায় বলে, "বাংলা দেশের স্বাধীনতা আজ বাস্তব সত্যে পরিণত হয়েছে… বাইরের সাহায্য ছাড়াই আমাদের নিজেদের শক্তি দিয়ে বাঙ্গালীর এই স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারত বা অন্য কোন দেশের সাহায্য নেয়া যাবে না (দৈনিক পাকিস্তান, ১৪ মার্চ)। এইদিন 'শোষণমুক্ত স্বাধীন বাংলা কায়েমের' দাবিতে ছাত্র ইউনিয়ন মশাল মিছিল বের করে বায়তুল মোকাররম থেকে। মিছিলটি নানা পথ ঘুরে, শহীদ মিনারে এসে শেষ হয় (দৈনিক সংবাদ, ১৪ মার্চ)।

১৪ মার্চ বাংলা একাডেমীতে ডক্টর আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে লেখক সংগ্রাম শিবির এক সভা করে। এখান থেকে মুক্ত সার্বভৌম বাংলা দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবর রহমান ও মাওলানা ভাসানি সহ সকল রাজনৈতিক নেতাকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবার আহবান জানানো হয় (দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ মার্চ)।

একই দিনে বায়তুল মোকাররমে জনসভা করে ছাত্র ইউনিয়ন। কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি নূরুল ইসলাম মাওলানা ভাসানি'র সমালোচনা করেন। ১৩ মার্চ ভৈরবে ভাসানি বলেছেন, বাংলা স্বাধীন হয়ে গিয়েছে, স্বাধীনতার স্লোগান দেয়ার প্রয়োজন নাই। এই ধরণের বক্তব্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম'কে স্তিমিত করা যাবে না (দৈনিক সংবাদ, ১৫ মার্চ)। এই দিনই ঢাকায় আসেন মস্কোপন্থী ন্যাপ এর সারা পাকিস্তান প্রধান ওয়ালী আহমদ। তিনি এইদিন দলীয় কর্মীসভায় বলেন- "পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ বাংলার ন্যায্য দাবী সমর্থন করে।" (ঐ)

১৫ মার্চ রংপুরে ন্যাপ (ওয়ালী) ও ছাত্র ইউয়নিয়নের যৌথ উদ্যোগে জনসভা হয় (দৈনিক সংবাদ, ১৬ মার্চ)।



১৬ মার্চ - ২৫ মার্চ

মার্চের চূড়ান্ত সপ্তাহে সবাই বুঝে গেছে, পাকিস্তান আর থাকছে না। কিন্তু সেই জন্য কি প্রস্তুতি ছিল আসলে বামপন্থীদের?

১৬ মার্চ, মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা শুরু হয়।

এইদিন ভাসানি বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রামের লালদিঘীতে। আর মহিলা পরিষদের উদ্যোগে কুচকাওয়াজ ও বায়তুল মোকাররমে পথসভা অনুষ্ঠিত হয় (দৈনিক সংবাদ, ১৭ মার্চ)।

১৭ মার্চ মস্কোপন্থী ন্যাপের উদ্যোগে জনসভার সংবাদ পাওয়া যায় টাঙাইল, নোয়াখালী, বোলঘর, খেপুপাড়া, রংপুর ও বসুরহাটে (দৈনিক সংবাদ, ১৮ মার্চ)।

১৮ মার্চ রাজশাহীতে ন্যাপ (ওয়ালী) ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ বৈঠক করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সাথে। সেখানে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ঐক্যবোধ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয় (দৈনিক সংবাদ, ১৯ মার্চ)।

এই দিনেই, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে রাইফেল চালানো প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। সাথে ছিল মার্চ পাস্ট। এখানে আয়শা খানম জানান, আজ সকলেরই উচিত এই ট্রেনিং সেন্টারে এসে কড়া নিয়মানুবর্তিতার সাথে ট্রেনিং নিয়ে রাখা। ভবিষ্যতে তাহলে দেশ ও জাতি যে কোন অবস্থার মোকাবিলা করতে সমর্থ হবে (দৈনিক পাকিস্তান, ১৯ মার্চ)।

১৯ মার্চ চট্টগ্রামের লালদিঘীতে জনসভায় ভাসানি, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে, তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান (দৈনিক সংবাদ, ২০ মার্চ)।

সূত্রঃ দৈনিক সংবাদ, ২০ মার্চ ১৯৭১

২০ মার্চ, শেখ মুজিবর রহমান বৈঠক শেষে জানিয়েছিলেন, সংকট নিরসনের পথে এগুচ্ছে। একই দিনে জানা যায়, ভুট্টো ঢাকায় আসছেন।

এই দিন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ১০ দিনব্যপী শিক্ষা শিবিরের সমাপনই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় তিনশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। 'ছাত্র ইউনিয়ন গণবাহিনী' লেখা ব্যানার নিয়ে পরে রাজপথেও মিছিল করে শিক্ষার্থীদের ১২ টি প্লাটুন।

তাদের এই কর্মুসচী নিয়ে একটু ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায় রাশেদ খান মেনন'র লিখায়। তিনি বলেন- ৭ মার্চের পরে ব্যতিক্রমী অবস্থান ছিল মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের। তারা স্লোগান তুলেছিল- 'পূর্ব পশ্চিম এক আওয়াজ/ কায়েম কর গণরাজ'। মতিয়া গ্রুপের ছাত্র ইউনিয়নের মেয়েরা ডামি রাইফেল নিয়ে যে বিখ্যাত মিছিলটি করে, সেখানেও ব্যানারে লেখা ছিল- 'মেশিন গানের সম্মুখে গাই জুঁই ফুলের এই গান' (ঐ)। সেই সময় মেনন সাহেবরা গন্ধক চুরি করে বোমা বানান কিছু, অস্ত্রের দোকান থেকে টু টু বোরের রাইফেল হাতিয়ে নেন আর পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র জুনো বোমা বানানোর ফর্মুলা বের করে সারা দেশে সেটা পাঠিয়ে দেয়। নিজেরাও ঢাকায় বোমা বানানোর নানা এক্সপেরিমেন্ট করে (ঐ, ৩৫৭)।

২০ মার্চ পাবনায় ন্যাপ (ওয়ালি) ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ সমাবেশে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে বাংলা দেশের মুক্তির জন্য যৌথ কর্মসুচী গ্রহণের আহ্বান জানানো হয় (দৈনিক সংবাদ, ২১ মার্চ)।

২১ মার্চ ভূট্টো এসে পৌঁছান ঢাকায়। ঐদিন চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে জনসভা করেন ভাসানি (দৈনিক আজাদী, ২১ মার্চ)।

এই সময়ের কথা হায়দার আকবর খান লিখেছেন তার স্মৃতিকথা 'শতাব্দী পেরিয়ে' বইতে। তিনি লিখেছেন, "মার্চ মাসের তৃতীয় বা চতুর্থ সপ্তাহে একবার আমি এবং কাজী জাফর আহমদ তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল হোক মনি ও সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে সারারাত ধরে আলোচনা করি। বৈঠকটি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাংলার অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের ফ্ল্যাটে।… আমরা একমত হই যে, আলোচনা ব্যর্থ হবে এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের কোন পরিকল্পনা বা যৌথ কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত হয়নি (পৃষ্ঠা ২৩৫)।

চট্টগ্রাম থেকে ফিরে ঢাকার পল্টনে ২৩ মার্চ জনসভা করার কথা ছিল ভাসানির। কিন্তু ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হওয়ায় সেই জনসভা বাতিল করার কথা জানান চট্টগ্রাম ন্যাপের আহবায়ক জনাব বজলুস সাত্তার (দৈনিক পাকিস্তান, ২২ মার্চ)।

২১ মার্চ মস্কোপন্থী ন্যাপ এর কর্মীসভায় মোজাফফর আহমদ বলেন, "যে কোন অবস্থার মুখে দেশবাসীর স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক দাবি দাওয়া ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত গতিতে অগ্রসর হবে।" তিনি দেশবাসীকে কঠিন ও কঠোর সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ ও গণমুক্তি বাহিনী গঠনের আহ্বান জানান। একই সাথে ২৮ মার্চ পল্টনে সভা করার ঘোষণা দেন (দৈনিক পাকিস্তান, ২৩ মার্চ)। একই সাথে সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আগামীতে শহরের প্রতিটি ইউনিয়নে সংগ্রাম পরিষদ ও মুক্তি বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেয়া হবে।

২১ মার্চ 'গণশক্তি' পত্রিকায় বদরুদ্দিন উমর লিখেছিলেন, 'এই অহিংস অসহযোগ আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাংলার কৃষক শ্রমিক ও ছাত্রদের হাত থেকে সংগ্রামের পতাকা খুব সুকৌশলে কেড়ে নিয়েছে। গ্রামে গ্রামে কৃষকরা সংগ্রামে যোগদানের জন্য বিভিন্ন রকম দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন শত্রুদের মোকাবিলা করতে, কিন্তু অহিংস অসহযোগের কথা বলে শেখ মুজিব তাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন (বামপন্থার সুরতহাল, মহিউদ্দিন আহমেদ, ১১০)।

২২ মার্চ, মানুষ হতভম্ব হয়ে শুনতে পায়, ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনও স্থগিত হয়ে গেছে। দেশ তখন স্বাধীন বাংলার পতাকায় ছেয়ে গেছে।

২৩ মার্চ ভাসানি'র অনুপুস্থিতিতেই জনসভা করে ন্যাপ (ভাসানি)। ভাসানি'র একটি বার্তা এই সভায় পড়ে শোনানো হয়। বার্তায় তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা'কে সর্বান্তকরণে মেনে নিতে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান (The People, 24 March)।

এখানে সাধারন সম্পাদক তাহের বলেন, "আমরা স্বাধীন বাংলার কোন পতাকা উড়াইনি। আমরা সময়ের অপেক্ষা করছি। সময় আসলে সকল দলে মিলে একটা পতাকা তৈরি করব।" এই সভায় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে বামপন্থী সকল দলকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান জানানো হয় (দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ মার্চ)।

২৩ মার্চ রাস্তায় নেমেছিলেন বুয়েটের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষকরা। (সূত্রঃ দৈনিক সংবাদ, ২৪ মার্চ ১৯৭১ )

একই দিনে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জনসভা করে ছাত্র ইউনিয়ন। সভায় সভাপতি নূরুল ইসলাম শেখ মুজিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন-

একদিকে আলোচনা চলছে অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠীর পাহারাদার সেনাবাহিনী বাংলা দেশে গুলিবর্ষণ, গণহত্যা ও জনগণের উপর নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে।… অনির্দিষ্টকালের জন্য আলোচনা চলতে পারে না। চট্টগ্রামেও শোষণমুক্ত বাংলা দেশ কায়েমের দাবিতে জনসভা করে ছাত্র ইউনিয়ন (দৈনিক সংবাদ, ২৪ মার্চ)।

সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে কাজী জাফর, শেখ মুজিবের সাথে দেখা করলে তিনি বলেন, 'তোমাদের গেরিলা যুদ্ধ করা লাগবে না। এহিয়ার সঙ্গে আমি দেখছি। আর তাজউদ্দীন এদিকে বাকিটা দেখছে।' ফলে পার্টি স্থির করে, ২৫ মার্চ ঢাকায় পল্টনে জনসভা হবে এবং সেখান থেকে শেখ মুজিব'কে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য আহবান জানানো হবে। সেইমতে জনসভা হল 'পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন' এর ব্যানারে। সভার মাঝখানেই ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক যাদু মিয়া খবর পাঠান, দ্রুত জনসভা শেষ করে চলে যেতে। কারণ পাকিস্তনা বাহিনী না কি এই জনসভাকে 'সফট বেলি' টার্গেট করার প্ল্যান করেছিল (এক জীবন, রাশেদ খান মেনন)।

২৫ মার্চ রাতে যে পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ করতে যাচ্ছে, এটা ন্যাপ নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য জানতে পারেন মধুদার কাছ থেকে, বিকেল ৩ টায়। মধুদা এনএসএফ'র নেতাদের কথা শুনে ফেলেছিলেন। পঙ্কজ ভট্টাচার্য এই খবর পুছে দেন কমরেড ফরহাদ'র কাছে; ওখানে সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও মতিয়া চৌধুরী'ও ছিলেন। শহীদুল্লাহ কায়সার'কে দায়িত্ব দেয়া হয় শেখ মুজিবর রহমান'কে খবর পৌঁছে দিতে।

বিকেল ৫ টায় বসে কমিউনিস্ট পার্টির জরুরী বৈঠক। সাথে ছিলেন ন্যাপ নেতা মোজাফফর আহমদ'ও (আমার সেই সব দিন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, ১১৩)। এই বৈঠকে কি সিদ্ধান্ত হল, সেটা আর পঙ্কজ বলেননি। কিন্তু মে মাসের ৩ তারিখের আগে কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে আর কোন বক্তব্য আসেনি।

২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে নানা গুজব শুনে হায়দার আকবর খান রণো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাসায় না থাকার। ভাই জুনো'কে নিয়ে চলে গেলেন তার খালার বাসায়; সেখানেই থাকলেন ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত (শতাব্দী পেরিয়ে, পৃষ্ঠা ২৩৮)।



কি বোঝা গেল?

খানিকটা অবাক করার ব্যাপার হল, মার্চজুড়ে প্রায় সব বামপন্থী দলগুলো স্বাধীন বাংলা দেশ এর কথা বলেছে, জনগণকে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু লড়াইটা যখন এসে গেল, তখন সবাইকে মনে হচ্ছিল দিশেহারা।

মার্চের আগেই 'বাংলার স্বাধীনতার' কথা বলেছে বেশ কয়েকটি বামপন্থী দল, কর্মসুচীও দিয়েছে। কিন্তু এই লেখায় মার্চ মাসটাকে বেছে নেয়ার মূল কারণই হল, ঝড়ো সময়ে দলগুলোর বক্তব্য বা কর্মকান্ড বোঝার চেষ্টা করা। আওয়ামী লীগের সাথে তুলনায় সাংগঠনিক এবং জনঘনিষ্টতায় অনেক পিছিয়ে থাকার পরেও দলগুলো তাদের নিজেদের মত করে বক্তব্য তুলে ধরেছে, লিফলেট ছাপিয়েছে, পত্রিকায় সংবাদ হয়েছে, মিছিল মিটিং করেছে। প্রচারের ক্ষেত্রে খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি; তাদের প্রকাশ্য সংগঠন ন্যাপ'র দৈনিক পত্রিকা 'সংবাদ' তখন ভালই চলছিল। পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির ছিল 'গণশক্তি', কিন্তু সেটা ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা।

প্রচার যাই হোক না কেন, এটা ঠিক যে, সেই সময় পাদপ্রদীপের আলোয় শেখ মুজিব। তার সাথে খানিকটা মনযোগ দাবি করেছিলেন মাওলানা ভাসানি। কিন্তু ৮৯ বছরের শরীর আর অগোছালো সংগঠন নিয়ে খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে পারেননি। খানিকটা অবাক করার ব্যাপার হল, মার্চজুড়ে প্রায় সব বামপন্থী দলগুলো স্বাধীন বাংলা দেশ এর কথা বলেছে, জনগণকে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু লড়াইটা যখন এসে গেল, তখন সবাইকে মনে হচ্ছিল দিশেহারা। কোন গভীর প্রস্তুতি, কোন বিকল্প পরিকল্পনা থাকার ছাপ তাদের মধ্যে ছিল না।

এর একটা কারণ হতে পারে, ২৫ মার্চ নৃশংসতা যে এতটা ভয়াবহ হবে, সেটা তারা আন্দাজ করতে পারেননি। সেই ভয়াবহ রাতের পরে কে কিভাবে কাজ করেছিলেন, তা নিয়ে অন্য লেখায় বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে থাকল।

পড়ে দেখতে পারেন


  • ম্যাপে যেমন দেখাচ্ছে, ২০৫০ সালে নীল চিহ্নিত অংশ তলিয়ে যেতে পারে পানির নিচে।

  • দল হিসেবে নিবন্ধনের শর্তগুলো

    বাংলাদেশে দল হিসেবে নিবন্ধন করতে হলে অবশ্যই স্বাধীনতার পরে কমপক্ষে একটি সংসদের আসনে নির্বাচিত হতে হবে! অথবা কমপক্ষে ২১ জেলায় সংগঠন থাকতে হবে।