আমেরিকা কি সেন্ট মার্টিন নিয়ে নিতে চায়?

শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বলেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আসলেই সেন্ট মার্টিন কতটা ইম্পর্ট্যান্ট? আমেরিকা কি সত্যি সত্যি ঘাঁটি গেড়ে বসতে চাচ্ছে এখানে? দখল হারাব আমরা আমাদের নীলাভ স্বর্গদ্বীপের ওপর?
আমেরিকা, সেন্ট মার্টিন আসলেই নিয়ে যাবে কি না, সেটা বোঝার জন্য কয়েকটা বিষয় বিবেচনা করা দরকার।

- এক। বঙ্গোপসাগরে সামরিক অবস্থান কেন গুরুত্বপূর্ণ?
- দুই। আমেরিকা কেন বঙ্গোপসাগরে ঘাঁটি গাড়তে চাইবে?
- তিন। সেন্ট মার্টিন কি আসলেই ঘাঁটি করার জন্য উপযুক্ত জায়গা?
বঙ্গোপসাগরে সামরিক অবস্থান কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বঙ্গোপসাগরের নিজের অবস্থানই একে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। বঙ্গোপসাগর দিয়ে মালাক্কা প্রণালী হয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে বেশ বড় সংখ্যায়। নৌপথ সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য এই অঞ্চলে সামরিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
চীন তার “স্ট্রিং অব পার্লস” বা "মুক্তোর মালা" গড়ে তোলার নীতি অনুসরন করছে। সে চায় তার চারপাশে প্রভাব বলয় বাড়তে। সাথে সাথে চীন ভারতকেও কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলতে চাইছে, যাতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তার এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্যদিকে ভারতও এই অঞ্চলে আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। সে পাল্টা নিয়েছে 'নেকলেস অফ ডায়মন্ড' নীতি। ভারত তার ইস্টার্ন নেভাল কমান্ড (বিশাখাপত্তনম) এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ত্রি-বাহিনী কমান্ড শক্তিশালী করেছে। সাথে সাথে বঙ্গোপসাগরে নতুন সাবমেরিন, যুদ্ধজাহাজ, এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার ও নজরদারি ড্রোন মোতায়েন করেছে। যুক্ত করছে INS বিশাখাপত্তনম, INS কর্নাটক, ও INS কোলকাতা-এর মতো যুদ্ধজাহাজ। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের উন্নয়নে সহযোগিতার জন্য ভারত উদগ্রীব হয়ে আছে, মূলত চীনের পাল্টা অবস্থান গড়ে তোলার জন্য।
বঙ্গোপসাগরে আছে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল ভাণ্ডার। সমুদ্রের ২২টি ব্লকে ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট বা তারও বেশি পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে ব্লক ১২, ১৬, ২১-এ গ্যাস অনুসন্ধান চলছে। মিয়ানমার তার উপকূলে বড় গ্যাসক্ষেত্র (Shwe Gas Field) আবিষ্কার করেছে, যার কতৃত্ব ইতোমধ্যে চীনের হাতে চলে গেছে। ভারতও বঙ্গোপসাগরের অংশে (কৃষ্ণা-গোদাবরী অববাহিকা) তেল ও গ্যাস উত্তোলন করছে।
বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ইলমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট, গার্নেট, মোনাজাইট, কায়ানাইট এবং লিকোক্সিনসহ ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ বালু পাওয়া যায়। বছরে প্রায় ১০ লাখ টন এসব খনিজ আহরণ করা সম্ভব।
বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের মৎস্য শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খানে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি এবং ২০ প্রজাতির কাঁকড়ার সন্ধান পাওয়া গেছে, যা রপ্তানিযোগ্য সামুদ্রিক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। বঙ্গোপসাগরে ৩৩৬ প্রজাতির শামুক ও ঝিনুকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা মুক্তা উৎপাদনসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।
এই বিপুল সম্পদ, সমুদ্র বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ আর আঞ্চলিক ক্ষমতার টক্করের কারণে বঙ্গোপসাগরে সামরিক ঘাঁটি যে কাউকেই শক্তিশালী অবস্থান এনে দিতে পারে।
আমেরিকা কেন বঙ্গোপসাগরে ঘাঁটি গাড়তে চাইবে?

তার চাই এমন একটা অঞ্চল বা এমন একটা দেশ, যেখানে বসে দুই পক্ষের লড়াইয়ের দিকে নজর দেয়া যাবে আবার চাইলে যে কোন বিষয়ে নাকও গলানো যাবে।
দক্ষিণ এশিয়ার বড় বাজারে ঢুকতে না চাইবার কোন কারণ নেই আমেরিকার। আগ্রহ ষোল আনা, কিন্তু চীন-ভারত দ্বৈরথ মোকাবিলা না করে উড়ে এসে এখানে জুড়ে বসা তার জন্য ভাল ফল না-ও আনতে পারে। তার চাই এমন একটা অঞ্চল বা এমন একটা দেশ, যেখানে বসে দুই পক্ষের লড়াইয়ের দিকে নজর দেয়া যাবে আবার চাইলে যে কোন বিষয়ে নাকও গলানো যাবে। এই বিবেচনায় বাংলাদেশ যে তার জন্য সবচেয়ে আকর্ষনীয় জায়গা- সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কম।
বাংলাদেশ যে চীন আর ভারত- দুইজনেরই আগ্রহের মাঝামাঝি জায়গায় আছে, তার প্রমাণ ভুরি ভুরি দেয়া যায়। বাংলাদেশ ও চীন ২০২৪ সালের মে মাসের শুরুতে তাদের প্রথম যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করে, যার কোড নাম ছিল ‘চায়না-বাংলাদেশ গোল্ডেন ফ্রেন্ডশিপ ২০২৪’। যদিও বাংলাদেশ ও ভারত ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১১টি সামরিক মহড়া পরিচালনা করেছে, চীনের সাথে এই মহড়া ভবিষ্যতের জন্য তাৎপর্যপূর্ন।
এতদিন ভারতের জন্য উদ্বেগজনক ব্যাপার ছিল, চীন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক। বাংলাদেশকে সে যুদ্ধবিমান, যুদ্ধ ট্যাংক, নৌ ফ্রিগেট, সাবমেরিন এবং ক্ষেপণাস্ত্র বোটের মত সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। বাংলাদেশ তার সামরিক সরঞ্জামের প্রায় ৮৬ শতাংশই চীন থেকে সংগ্রহ করে। এ নিয়ে ভারতের আপত্তি ছিল প্রবল।
দুই বড় প্রতিবেশীর এই সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বাংলাদেশের পাশে আশ্বাস নিয়ে এসে দাঁড়াতে পারে আমেরিকা।
সোনাদিয়া দ্বীপ নিয়ে চীনের আগ্রহ ছিল দীর্ঘদিনের। শুরুটা করে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রজেক্ট দিয়ে। পরে একে আরও বহুদূর এগিয়ে নিতে ছেয়েছিল সে। কিন্তু ২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। এটা ভারতের জন্য স্বস্তিকর হলেও, চীন ভাল ভাবে নেয়নি বিষয়টি।
একইভাবে ভারতীয় আপত্তির মুখে চীন হারায় পায়রা বন্দরের কাজও।
এখন ভারতের সাথে আমেরিকার অন্তত চীন বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে। দুইজনেই চায় চীনকে হটাতে। কিন্তু তাই বলে, আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে অবসান নিলে সেটা ভারতের জন্যও হয়ত সুখখর হবে না। সেটা জেনেই, ভারতও ঐ প্রজেক্টে খুব বেশি আগ্রহী হবে বলে মনে হয় না।
বঙ্গোপসাগরে ঘাঁটি করলে, আমেরিকা যেসব সুবিধা পেতে পারে, সেগুলো হল-
- চীনের 'স্ট্রিং অফ পার্ল' নীতি ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে পারে। চট্টগ্রাম, মিয়ানমার আর শ্রীলংকার বন্দরে চীনের অবস্থানের ওপর নজর রাখতে পারে।
- নৌপথে মালাক্কা প্রণালীর উপর কতৃত্ব করতে পারে। এই পথেই বিশ্ব বাণিজ্যের ৩০% আর চীনের জ্বালানি সরবরাহের ৫০% চলাচল করে।
- আমেরিকা তার ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী এখানে ঘাঁটি গড়ে চীনবিরোধী বন্ধু ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর জাপানের সাথে আরও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।
- বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি মার্কিন বাহিনীর জন্য একটি ফরওয়ার্ড অপারেটিং স্টেশন হিসেবে কাজ করবে। দক্ষিণ চীন সাগর, ভারত মহাসাগর বা মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুত হস্তক্ষেপের জন্য সেটা সহায়ক হবে।
সেন্ট মার্টিন কি আসলেই ঘাঁটি করার জন্য উপযুক্ত জায়গা?

মিজাইল সাইলোর জন্য দরকার পাহাড়ই জায়গা, যাতে শত্রুরা চাইলেই এসে বোমা ফেলে সেগুলো ধ্বংসা করতে না পারে। তেমন জায়গাও সেন্ট মার্টিনে নেই।
বঙ্গোপসাগরে ঘাটি করলে আমেরিকার যে সুবিধা, তা নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশই নেই। কিন্তু সেন্ট মার্টিন কি আসলে ঘাটি হিসেবে উপযুক্ত জায়গা?
সেন্ট মার্টিনের প্রস্থ ৭ কিলোমিটার আর দৈর্ঘ্য ১২ কিলোমিটার। এত কম জায়গায় মিলিটারি বেইজ হওয়া আসলেই খুব কঠিন। এই ছোট জায়গায় রানওয়ে হবে না, ট্যাক্সিওয়ে হবে না, থাকবে না ফাইতার প্লেনগুলোর জন্য কোন নিরাপদ জায়গা।
মিজাইল সাইলোর জন্য দরকার পাহাড়ই জায়গা, যাতে শত্রুরা চাইলেই এসে বোমা ফেলে সেগুলো ধ্বংসা করতে না পারে। তেমন জায়গাও সেন্ট মার্টিনে নেই।
উপকুল থেকে এর দূরত্ব সামান্য। আর্টিলারি শেল ১০ থেকে ৪০ কিলোমিটারের মধ্যেই কার্যকর। মিয়ানমারের উপকুল থেকে দ্বীপের দূরত্ব ১০ কিলোমিটারেরও কম। মিয়ানমারের পাহাড়ি এলাকা থেকে এমনকি কাঁধে ব্যবহার করা মিজাইলও এখানে ঘাঁটির নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে।
আবহাওয়াও এখানে কোন রকম জাহাজ ভেড়ার পক্ষে অনুকূল নয়। এর উত্তর পূর্ব দিকে সরু প্রবাল রিফ জাহাজ নেভিগেশনের জন্য মোটেই ভাল না। পশ্চিম দিকের কোরাল রিফ আর উত্তাল আবহাওয়া জাহাজ ভেড়ার জন্য উপযুক্ত না কোন বার্থ শিপ এখান নোঙ্গর ফেলতে পারবে না।
তাহলে?
যদিও সমুদ্র বাণিজ্য রুটের ওপর নজরদারি এবং চীনের প্রভাব ঠেকানোর জন্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এর আকার এবং জলবায়ুর কারণে পূর্ণাঙ্গ সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য আদর্শ নয়। তাছাড়া, বাংলাদেশ এবং এর প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক, দ্বীপে সামরিক উপস্থিতি স্থাপনের বিষয়টি জটিল করে তুলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ভারত বা শ্রীলংকায় এমন বিকল্প স্থান খুঁজে পাবে যেখানে আরও বেশি অবকাঠামো সক্ষমতা এবং ভূরাজনৈতিক সমর্থন রয়েছে।