ওশেন ইয়ং এর যুদ্ধময় এক জেন জগত

দুটি মাত্র বই গড়ে দিয়েছে ব্যবধান।
লেখক ওশেন ইয়ং 'অখ্যাত' এক অভিবাসী থেকে হয়ে উঠেছেন সাহিত্য জগতের স্টার। একটি বই কবিতার; নাম 'Night Sky with Exit Wounds'; আরেকটা উপন্যাস- 'On Earth We’re Briefly Gorgeous'। পেয়েছেন হোয়াইটিং অ্যাওয়ার্ড, টি.এস. এলিয়ট পুরষ্কার, জিনিয়াস গ্রান্ট- ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ।
গভীর ব্যক্তিগত আখ্যান ইয়ং এর।
সমালোচকরা বলেন- কবিতার মত সুন্দর গদ্যে ইয়ং তুলে আনতে পারেন পরিচয় রাজনীতিকে; সাথে থাকে স্বজন হারানোর বেদনা আর ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর কথা। অভিযোগ আছে, দুর্বোধ্যতারও। কিন্তু সেই অভিযোগ কার সম্পর্কে নেই!
“আমার মাথার ভেতর যুদ্ধ চলছে সব জায়গায়,” নিজের কবিতার বই Time Is a Mother-এ লিখেছেন এই ভিয়েতনামি-আমেরিকান লেখক।
"বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। ভিটে হারানো পলাতক শরণার্থী, সন্তানদের হাত আঁকড়ে ধরে বাবা মায়ের দৌড় - এই সব হৃদয়বিদারক দৃশ্য মানুষের জন্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।” ইউক্রেনে রাশান হামলা শুরু হলে বলেছিল ইয়ং। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ছাত্রদেরও একই কথা বলেছে সে, “যদি সাহিত্য পড়তে চাও, যুদ্ধকে বুঝতে শেখো। যতদিন সৈন্য থাকবে, ততদিন থাকে কবিরাও।”
ওশেন ইয়ং যুদ্ধের সন্তান, এটা নিছক কথার কথা না। তার নিজের কবিতায় আছে-
“একজন আমেরিকান সৈন্য এক ভিয়েতনামি কৃষক কন্যার সাথে শুয়েছিল। ফলে জন্ম হল আমার মায়ের। আর তার ফলে জন্মালাম আমি।”
ভিয়েতনামের সাইগনে, এক ধানক্ষেতে জন্ম তার। শৈশব কাটে ফিলিপাইনের এক শরণার্থী শিবিরে। মাত্র দুই বছর বয়সে তাঁর মা তাকে নিয়ে পালিয়ে আসেন আমেরিকায় ।
On Earth We’re Briefly Gorgeous এ উঠে এসেছে সেই ধানক্ষেতের গল্প, উঠে এসেছে নিউ ইংল্যান্ডের তামাক খামারের কথা, নাপাম বোমার কথা এমনকি আমেরিকার ওপিডয়েড সংকটের কথা। এই ৯/১১-এর পরবর্তী জগতে বেড়ে উঠছিল এক গরীব, সমকামী ছেলে। উপন্যাসটা সে লিখেছে নিজের নিরক্ষর মা'কে উদ্দেশ্য করে।
ইয়ং নিজেও ১১ বছর বয়স পর্যন্ত পড়তে পারেননি। অথচ ৩০-এর আগেই তার প্রথম কবিতার সংকলন Night Sky With Exit Wounds সময়ের অন্যতম উজ্জ্বল কবির স্বীকৃতি এনে দিয়েছিল। কোন কোন সমালোচক তাকে তুলনা করেছেন এমিলি ডিকিনসন ও জেরার্ড ম্যানলি হপকিন্সের সাথে।
অভিজ্ঞতাই কি তাকে কবি করে তুলেছে?
তার নিজের ক্লাশে এক সাদা চামড়ার ছাত্র বিড়বিড় করে না কি বলেছিল, "কি ভাগ্য তোমার! একে তুমি সমকামী, তার উপর যুদ্ধ নিয়েও লেখার ক্ষমতা রাখ। আমার তো লেখার কিছুই নেই!” সেই ছাত্রের কথা ইয়ং তুলে এনেছে নিজের লেখা কবিতা 'I got nothing' এ।
এখন ৩৯ বছর বয়সী জেন বৌদ্ধ ইয়ং On Earth We’re Briefly Gorgeous-এ লিখেছিল, “আমার উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, ওজন ১১২ পাউন্ড। মাত্র তিন দিক দিয়ে দেখলে আমি দেখতে খারাপ না, আর বাকি সব দিক থেকে ভয়ংকর।”
গভীর চোখের কোটর আর ধারালো চোয়ালের রেখা নিয়ে সে যেন অন্য কোনো জগতের মানুষ। গাড়ি চালাতে জানে না, কখনো উবার ব্যবহার করে না, ফোনে অ্যাপ বলতে আছে কেবল ইনস্টাগ্রাম। কণ্ঠটা তার কবিতার মতই নরম।
Someday I’ll Love Ocean Vuong, ইয়ং এর নিজের লেখা কবিতাটা পড়লে ওকে আরও একটু ভালোবেসে ফেলা যায়।
২০১৯ এ মায়ের মৃত্যুর পরে ইয়ং এর প্রথম বই ছিল- Time Is a Mother। নেইল সেলুনে দীর্ঘ সময় বিষাক্ত রাসায়নিকের কাছাকাছি থাকার কারণেই হয়ত মাত্র ৫১ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান তিনি। মায়ের সেই দিনগুলোর কথা ইয়ং লিখেছে Amazon History of a Former Nail Salon Worker কবিতায়।
ওশেন ইয়ং মনে করে তার লেখার গতি খুবই ধীর।
Night Sky with Exit Wounds লিখতে তার লেগেছিল আট বছর; On Earth We’re Briefly Gorgeous পাঁচ বছর। Time Is a Mother-এর বেশির ভাগ কবিতা লেখা হয়েছিল মায়ের মৃত্যুর আগেই, কিন্তু কিভাবে যেন তবু কবিতাগুলোতে শোকই প্রধান সুর।
“আমি তো আজীবন শোকের মধ্যেই আছি,” ইয়ং এর ব্যাখ্যা। “বন্ধু, পরিবার, কিংবা সবার যে শোক—আমরা সবাই কোন না কোনোভাবে শোকের মধ্যেই থাকি। আর একমাত্র কবিতা দিয়েই সেই শোককে ভাগ করে নিতে পারি আরেকজনের সাথে।”
অনেকে বলে না যে, বই-ই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে! কথাটা ইয়ং এর ক্ষেত্রে আক্ষরিকভাবেই সত্য। ১৫ বছর বয়সে প্রথম লাইব্রেরিতে ঢুকে শেলফ থেকে বুদ্ধিজম এর উপর লেখা বইটা টেনে নেয়ার কথা এখন মনে পড়ে তার। “সেখানে লেখা ছিল: "বেদনায় তোমাকে স্বাগতম! তুমি তো আগে থেকেই বেদনার মধ্যে আছো, এবার সুস্থ হয়ে ওঠার পথগুলো দেখো।" লাইব্রেরিটি তার জন্য হয়ে ওঠে এক ধরনের আশ্রয়। ধীরে ধীরে গোগ্রাসে পড়তে শুরু করে আর সমস্ত বইগুলো।
হেমিংওয়ে বা রেমন্ড কার্ভারের নির্মোহ পুরুষতান্ত্রিক শৈলী নিয়ে সে সংশয়ী। তাকে টানে রোমান্টিক ঘরানার বাঁধনহীন আবেগ। সাহিত্যে বিদ্রূপ বা উন্মাদনাও নিতে পারে না সে। অন্য লেখকদের সাথেও মেশে না একদমই; কারণ, মিশলেই শুরু হয় নানা রকম গুজব আর কানকথা।
এখনো ইয়ং এর মনে হয় লেখালেখি তার জীবন থেকে 'চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে সময়'। কখনো সে লিখে রাতে; অভ্যাসটা হয়েছিল কলেজে পড়ার সময় দিনের বেলা ক্যাফেতে কাজ করতে গিয়ে। প্রথম খসড়া সে লিখে কাগজে কলমে, কারণ তাতে করে প্রতি বাক্য লিখতে ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড সময় বেশি লাগে। "এই সময়টাকে পুরো বইয়ের সময়ে বিচার করলে পার্থক্য বোঝা যাবে। কম্পিউটারে লেখার চেয়ে বেশি সময় তখন বইয়ের সাথে কাটান যায়।"
[সূত্রঃ https://www.theguardian.com/books/2022/apr/02/ocean-vuong-i-was-addicted-to-everything-you-could-crush-into-a-white-powder]