নোবেল বিজয়ী লেখক হ্যাং ক্যাং এর গল্প

দ্য ফ্রুট অফ ম্যাই উম্যান

ইংরেজি অনুবাদঃ ডেবোরাহ স্মিথ

Asad_USA
আমার বউ এর ঠোঁটের কোণায় সেই হাসি যেন আমাকে বলছে, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার।

মে মাসের শেষের দিকে প্রথম আমার বউয়ের গায়ের সেই দাগটা চোখে পড়ে। সেই দিন এই ফ্ল্যাটের দারোয়ানের বাসার পাশের বাগানে অসংখ্য ছেঁড়া জিভের মত ফোটা লাইলাক, বিল্ডিঙে ঢোকার মুখের বাঁধানো পথটাতে পড়ে মানুষের পায়ের নিচে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিল।

সূর্য তখন প্রায় মাথার উপরে।

আমাদের বসার ঘরের মেঝেতে এসে পড়া পাকা পিচ রঙের রোদের সাথে ছড়িয়ে যাচ্ছে ধুলোকণা আর ফুলের রেণু। যখন সেই বিষণ্ণ মিষ্টি কুসুম গরম রোদ এসে আমার সাদা জামার পিছনে গড়িয়ে পড়ে, আমি আর আমার বউ দুজনেই রোববার সকালের পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছি।

মাসখানেক ধরে যে কাজকর্মের ব্যস্ততায় খুব ক্লান্তি লাগছিল, গত সপ্তাহেও অনেক ঝামেলা গেল। এই বন্ধের দিনে তাই শুয়েছিলাম অনেকক্ষণ, ঘুম ভেঙ্গেছে এই কয়েক মিনিট আগে। বিছানায় শুয়ে অসাড় হয়ে আসা হাত পা নাড়িয়ে আরাম করে বসে খুব ধীরে পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাচ্ছি।

Description

'একটু দেখবে? এই দাগটা যাচ্ছে না কেন বুঝতে পারছি না।'

চুপচাপ সময়ে হঠাত বউয়ের কথা শুনে একটু বিরক্তি লাগায় কথার মানেটা ভাল বুঝে উঠতে পারিনি। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে তাকালাম ওর দিকে।

সোজা হয়ে বসলাম। পত্রিকার পাতার ভিতর আঙ্গুল রেখে, হাতের তালু দিয়ে চোখ কচলে তাকালাম। আমার বউ গেঞ্জিটা ব্রা পর্যন্ত তুলে দেখাল; পিঠ আর পেটের মাঝখানে গভীর কালশিটে দাগ।

'কিভাবে হল?'

কোমর মুচড়ে থাকার কারণে তার স্কার্টের ধার থেকে উঠে আসা হাড়ের সারি চোখে পড়ে। ওখানে বাচ্চাদের হাতের মুঠির সমান ফ্যাকাসে নীল কালশিটে, দেখে মনে হচ্ছে কালি দিয়ে আঁকা।

'তো? কিভাবে হল?' আমার তীক্ষ্ণ, জোরালো গলা এই আঠারো-পিয়ং ফ্ল্যাটের চুপচাপ পরিবেশটা ভেঙে চুরমার করে দিল।

'আমি জানি না… ভাবছিলাম, বেখেয়ালে কোথাও বাড়ি লেগেছে, চলে যাবে দাগটা… কিন্তু এখন দেখি কেবল বড় হচ্ছে।'

অপরাধী বাচ্চার মত আমার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে গেল ও। খানিকক্ষণ আগের গলার কর্কশ ভাব ঝেড়ে ফেলে, গলা নরম করলাম।

'ব্যথা করছে?'

'না না। দাগের জায়গায় আসলে কোন বোধই নেই। সেই জন্যই, বুঝলে, আরও চিন্তা হচ্ছে।'

যে অপরাধী ভঙ্গি খেয়াল করেছিলাম খানিক আগে, এখন আর তার চিহ্নও নেই, তার বদলে শান্ত বেমানান হাসি। আমার বউ এর ঠোটের কোণায় সেই হাসি যেন আমাকে বলছে, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার।

অদ্ভুতভাবে পরিস্থিতি ভুলে, আমি শান্ত আবেগহীন চোখে বউ এর চেহারাটা পরখ করলাম । মুখোমুখি এই চেহারা বড় অচেনা ঠেকছে। এতটাই অচেনা, প্রায় অবাস্তব; চার বছর একসাথে থাকলে যেমন চেহারা আশা করা যায়, তেমন নয় একেবারেই।

আমার বউ আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট, এই বছর উনচল্লিশে পড়েছে। বিয়ের আগে একসাথে বেরুলে তাকে দেখাত একদম কিশোরীদের মত - অনেকেই মনে করত স্কুলে পড়ে। এখন সেই চেহারায় ক্লান্তির চিহ্ন খুব বেশি স্পষ্ট, তার সাথে বেমানানভাবে মিশেছে চোখভরা সরলতা। কেউ এখন আমার বউ’কে স্কুল তো দুরে থাক, ইউনিভার্সিতির মেয়ে বলেও ভুল করবে না। বরং বয়সের তুলনাতেও ওকে বয়স্ক দেখায়। কাঁচা আপেলের মত তার গালে লাল রঙটা যেন ভেসে উঠতে উঠতেও তলিয়ে গেছে ধুসর কাদার ভিতরে। একসময় যে কোমর ছিল মিষ্টি আলুর চারার মত নরম, যে পেটের ভাঁজ ছিল মাথা খারাপ করে দেয়ার মত, এখন বড় করুণভাবে শুকিয়ে গেছে।

মনে করার চেষ্টা করলাম, শেষ কবে আমার বউ'কে দিনের আলোয় নগ্ন দেখেছি। ঐ বছর না, নিশ্চিত; আগের বছর কি না সেটাও মনে করতে পারলাম না।

একটা মানুষের সাথে থেকে, তার শরীরে এমন গভীর কালশিটে দাগ নজরে না এনে ছিলাম কি করে আমি? বউ'র চোখের কোণায় জমে থাকা ভাঁজগুলো গোনার চেষ্টা করলাম। তারপর বললাম, সব কাপড় খুলে ফেলতে। ওর শুকনো গাল লাল হয়ে উঠল দৃষ্টিকটুভাবেই। আপত্তি জানাল ও।

'কেউ দেখে ফেললে?'

Description

এই বিল্ডিঙের অন্য ফ্ল্যাটগুলো হয় বাগান নয় পার্কিং এ দিকে মুখ করা, কিন্তু আমাদের ব্যাল্কনিটা খোলা রাস্তার দিকে। সবচেয়ে কাছের বিল্ডিঙটা এখান থেকে তিন রাস্তা দুরে আর মাঝখানে আছে ছোট একটা নদী। তাই অনেক হাই পাওয়ার টেলিস্কোপ ছাড়া কারো এই বাসার ভিতরে নজর দেয়ার উপায় নেই। রাস্তা দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি থেকেও আমাদের বসার ঘরে কি হচ্ছে সেটা দেখা অসম্ভব। তাই ধরে নিলাম, আমার বউ আসলে লজ্জা পাচ্ছে। নতুন বিয়ে হওয়ার পরে বন্ধের দিনগুলোতে এই বসার ঘরেই গরমের মধ্যে দরজা জানলা খুলে, দিন দুপুরে একে অপরের শরীর আবিষ্কার করে যেতাম আমরা, ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত ।

বছরখানেক পরে অতটা ভালবাসা আর হত না, প্রথম দিককার সেই পাগলামি ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করেছিল। আমার বউটা বিছানায় যেত তাড়াতাড়ি, ঘুমও ছিল গভীর। আমি রাত করে ফিরলে নিশ্চিত জানতাম, টের পাবে না ও। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে এসে একা হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে অন্ধকার শোবার ঘরে ঢুকে ওর সমান তালে নিশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে খুব শূন্য মনে হত নিজেকে। নিঃসঙ্গতা কাটানোর আশায় তাকে জড়িয়ে ধরলে, ওর ঘুম জড়ানো আধখোলা চোখ দেখে ঠিক বুঝতে পারতাম না, আমাকে কাছে টানছে না কি দুরে ঠেলে দিচ্ছে। শুধু ঘুমিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত নিঃশব্দে আমার চুলে বিলি কেটে দিত।

'সব? সব খুলে ফেলতে বলছ?'

কান্না চাপা কাঁপা কাঁপা মুখ নিয়ে আমার বউ তার প্যান্টি খুলে ভাঁজ করে যোনিটা ঢেকে রাখল।

এই যে বসন্তের রোদে ওর নগ্ন শরীর দেখা যাচ্ছে। কতদিন হয়ে গেল!

কিন্তু তবু আমার মধ্যে এতটুকু উত্তেজনা জাগল না। দেখলাম, সেই হলদে-সবুজ কালশিটে কেবল ওর পাছার উপর না, পাঁজর আর হাঁটুতেও আছে, আছে উরুর ভিতর দিককার সাদা মাংসেও। দেখে ভীষণ রাগ হলেও সেটা কেটে গেল গভীর বিষাদের মেঘে। এই বেখেয়ালি ঘুমকাতুরে মেয়েটা কি করে ভুলে গেছে এই দাগের কারণ! আস্তে চলা কোন গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছে? বিল্ডিঙের সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেছে?

বসন্তের রোদ পিঠে নিয়ে, যোনি আড়াল করে দাঁড়িয়ে আমার বউ আনমনে যখন জিজ্ঞেস করে, হাসপাতালে যাওয়া উচিত কি না, এত করুণ আর বিষাদময় শোনায় শব্দগুলো যে, অবিশ্বাস্য বিষণ্ণতায় ডুবে গিয়ে ওর শুকনো শরীরটা জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে।



ভেবেছিলাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। সেই জন্য বসন্ত দিনে আমার বউ'র হাড় জিরজিরে শরীরটা বুকে টেনে নিয়ে বললাম, 'ব্যথা না করলে দাগ মিলিয়ে যাবে তাড়াতাড়ি। তুমি তো বড় কোন অসুখ বাধাওনি কখনো, না কি এইবার বাধিয়েছ?' বকার সুরটা জোরে হেসে হাল্কা করার চেষ্টা করলাম।

গরমকালের শুরুর দিকে এক রাতে ভ্যাপসা বাতাস যখন গাছের পাতাগুলোতে গাল ঘষে যাচ্ছে আর গনগনে রাস্তায় আঁধার নেমে আসল, আমার বউ উলটোদিকের চেয়ারে বসে খেতে খেতে শব্দ করে চামচ নামিয়ে রাখল। ততদিনে ওর দাগের কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

'অদ্ভুত ব্যাপার… দেখ তো আবার।'

গেঞ্জির হাতা গলে চিমসে হাত দুটো বের করে আমার বউ চট করে টি শার্ট আর ব্রা টা খুলে নিল। গিলে ফেলার আগেই আমার মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল।

বসন্তকালে যেখানে বাচ্চার হাতের মুঠির মত দাগ ছিল, সেটা বেড়ে এখন কচু পাতার মত বড় হয়েছে। তার ওপর, রঙটা গাড় হয়ে উঠেছে। আগে ছিল উইলো গাছের ডালের মত ম্লান, যেন গরমের ছোঁয়ায় হাল্কা সবুজ এখন গাড় নীল হয়ে উঠেছে।

কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে বউয়ের দাগ পড়া কাঁধ ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে মনে হল, অচেনা কারো শরীর যেন। এই রকম দাগের জন্য কেমন ব্যথা হতে পারে?

এটা চিন্তা করতে করতেই খেয়াল করলাম, ওর মুখটাও নীল হয়ে গেছে, যেন সীসার পানিতে ভেজানো। ওর উজ্জ্বল চুলগুলো শুকনো পাতার মত লালচে হয়ে আছে। চোখের সাদা অংশটাও কেমন হলদে দেখায়, যেন চোখের মনির রং গলে পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে।

Description

'এমন কেন হচ্ছে আমার? কেবল বাইরে যেতে ইচ্ছে করে, আর গেলেই… রোদ দেখলেই মনে হয় জামাকাপড় খুলে ফেলি। শরীর যেন সব খুলে ফেলতে চাইছে।' আমার বউ উঠে দাঁড়ালে সারা বছরে এই প্রথম ওর ভেঙ্গে পড়া নগ্ন শরীর দেখতে পেলাম। 'পরশু পুরো ন্যাংটো হয়ে ব্যাল্কনিতে ওয়াশিং মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জানি না কেউ দেখেছে কি না… লুকানোরও চেষ্টা করিনি… মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে গেছি!' আমি চুপ করে ওর চিমসানো নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অস্বস্তিতে চপস্টিকের ধারে আঙ্গুল বোলাচ্ছিলাম। 'আমার খিদে মরে গেছে। শুধু পানি খেতে ইচ্ছে করে… দুই লোকমা ভাতও খাওয়া হয় না দিনে। না খেতে খেতে মনে হয় পেটের এসিড ঠিকমত বেরুচ্ছে না। জোর করে খেলেও সব বেরিয়ে যায়।' সুতোয় বাঁধা পুতুলের মত আমার বউ হাঁটু ভেঙ্গে ওর মুখটা আমার উরুতে গুঁজে দিল। ও কি কাঁদছে? পাজামার ওপর উষ্ণ তরলের স্পর্শ পেলাম।

'দিনের মধ্যে অতবার বমি করলে কেমন লাগে, জান? মাটিতে দাঁড়িয়েও মনে হয় কোথাও যেন দৌড়াচ্ছি; হাচড়ে পাচড়ে হাঁটতে হয়, সোজা হওয়া যায় না। মাথায় এমন ব্যথা হয়… কেউ যেন ডান চোখটা গেলে দিয়েছে। কাঁধ শক্ত হয়ে যায়, লালা ঝরে, রাস্তায় পেটের হলদে অ্যাসিড, রাস্তার পাশের গাছের নিচে... '

ল্যাম্পের চারপাশে উড়তে থাকা পোকার গুঞ্জন ভেসে আসছে। তার ঘন আলোয় আমার বউ, পিঠে বিরাট বড় দাগ নিয়ে উগরে আসা কান্না গিলে ফেলতে পারে।

'হাসপাতালে যাও।' ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম। 'কাল সোজা মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে চলে যাবে।'

তার ভেজা, দাগে ভরা মুখ ঝাপসা দেখায়। বউ এর শুকনো খরখরে চুলে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে দাঁত বের করে হাসলাম। 'সাবধানে যাবে। আবার ব্যথা পেয়ো না। তুমি তো আর বাচ্চা না যে, পড়ে যাবে বা এটা ওটার সাথে বাড়ি খাবে।'

আমার বউ এর ভেজা মুখ হাল্কা হাসিতে কেঁপে উঠল, আর কান্নার একটা ধারা ঠোঁটের দিকে গড়িয়ে নামতে নামতে হারিয়ে গেল।


আমার বউ কি সব সময় এমন ছিঁচকাঁদুনে ছিল? না, ছিল না। প্রথম যখন কাঁদতে দেখি, ওর বয়স ছিল ছাব্বিশ।

বয়স কম হলে যেমন হয়, সহজেই হাসতে পারত, কন্ঠে ছিল উজ্বল সুর, হাসির প্রলেপে মোড়ানো। কিন্তু সে-ই একদিন বয়সের তুলনায় শান্ত আর রাশভারী কন্ঠে প্রথম কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল- 'শহরের ঐ সব উঁচু বিল্ডিঙে থাকতে আমার ভাল লাগে না। '

'সাত লাখ মানুষ ঠাসঠাসি করে থাকে, মনে হয় আমি দম বন্ধ হয়েই মারা যাব। সব বিল্ডিং, সব কিচেন, সব সিলিং, সব টয়লেট, বাথটাব, ব্যাল্কনি আর লিফট দেখতে একই রকম। এই সব পার্ক, বসার জায়গা, দোকান, ট্রাফিক লাইট- সব কিছু ঘেন্না লাগে আমার।'

'কেন বলছ এই কথা?' আমি এমনভাবে কথা বললাম যেন ব্যথা পাওয়া একটা বাচ্চাকে স্বান্ত্বনা দিচ্ছি, কথা থেকেও বেশি মনযোগ ছিল ওর কন্ঠের দিকে। 'অনেক লোক একসাথে থাকছে, এটা এত অপছন্দের কি হল?'

বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিলাম আমার বউ এর চোখে। ওর উজ্জ্বল জ্বলজ্বলে চোখ।

'আমি তো সব সময় বাসা ভাড়া নিতাম শহরের জমজমাট এলাকার কাছে। সেখানে অনেক মানুষের ভিড় থাকতে হবে, রাস্তায় রাস্তায় জোরে গান বাজবে, গাড়িতে গাড়িতে জট লেগে যাবে, তাদের হর্ণে কান ঝালাপালা হবে। নইলে তো থাকতেই পারব না। একা একা আমি থাকতে পারব না।' আমার বউ হাতের তালু দিয়ে চোখ মোছার পরেও অশ্রুর ধারা থামছিল না কিছুতেই। 'আর এখন মনে হচ্ছে অনেকদিন অসুখে ভুগে আমি মরে যাব। এই তেরো তলা থেকে কোনদিন নামা হবে না, কোনদিন বাইরে যাওয়া হবে না।'

'তুমি কিন্তু খুব বেশি বেশি চিন্তা করছ। আসলেই, বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু।'

এই উঁচু বিল্ডিঙে আমাদের প্রথম বছরে, ও প্রায়ই অসুস্থ থাকত। সিউলের পাহাড়ি এলাকায় নিরিবিলি বাসায় ভাড়া থাকত ও। এই সেন্ট্রাল হিটার, চারদিক আঁটসাঁট করা বন্ধ জানলা, সে নিতে পারছিল না। দিন দিন কেমন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল আমার বউ, অল্প কিছু টাকার জন্য পাবলিশিং হাউজের চাকরিতে যেতে কয়েক পা হাঁটতেই যেন হাফিয়ে উঠছিল।

কিন্তু আমাদের বিয়ের কারনে কিন্তু সে চাকরি ছাড়েনি। চাকরি ছাড়ার পরে, কিছুদিনের মধ্যেই, আমি ওর সাথে বিয়ে নিয়ে পরিষ্কার করে কথা বলেছিলাম। বেতন আর পেনশন থেকে জমানো সব টাকাই ও তুলে নিয়েছিল- সাথে যোগ হয়েছিল বন্ধের দিনে পার্ট টাইম কাজের বেতন; ও আসলে দেশ ছাড়তে চাইছিল।

'আমি শরীরে তাজা রক্ত ঢোকাতে চাই।' সন্ধ্যায় ও বলেছিল। ঐদিনই সে অবশেষে চাকরি ছাড়ার নোটিশ দিয়ে এসেছিল বসে কাছে।

শিরায় সিস্টের মত জমাট বাঁধা খারাপ রক্ত বদলে ফেলতে চেয়েছিল সে, আর ক্লান্ত পুরোনো ফুসফুসটা তাজা বাতাসে সতেজ করতে। নিজের মত করে বাঁচা-মরার স্বপ্ন দেখে সে ছোটবেলা থেকেই, সে বলেছিল; অপেক্ষা করছিল ঠিক সময়ের জন্য। এখন স্বপ্ন পূরণের যথেষ্ট টাকা তার হাতে আছে। ভেবেছিল, একটা দেশ বেছে নিয়ে, সেখানে ছয় মাস থাকবে, তারপর চলে যাবে অন্য দেশে। এভাবে চলতেই থাকবে।

'মরার আগে এটা আমি করবই।' সে বলেছিল, হালকা হাসি হেসে। 'পৃথিবীর শেষ প্রান্তটা দেখে ছাড়ব। একটু একটু করে যতটা সম্ভব দূরে চলে যাব।'

Description

কিন্তু পৃথিবীর প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই, আমার বউ তার সমস্ত জমানো টাকা এই ফ্ল্যাটের ডাউন পেমেন্ট আর আমাদের বিয়েতে খরচ করে ফেলল। ছোট কথায় ব্যাখ্যা দিয়েছিল সে। 'তোমার থেকে তো আমি আর দুরে যেতে পারি না।' ও কি নিজের স্বাধীনতার স্বপ্নে আসলেই বিশ্বাস রেখেছিল? এত সহজে যেহেতু স্বপ্নটা ছেড়ে দিতে পারল, হয়ত অতটা বিশ্বাস ছিল না, আমি ভেবেছিলাম।

পুরো ব্যাপারটা হয়তো ছিল একদম অবাস্তব, রোমান্টিক কল্পনা, আর তার পরিকল্পনাগুলো ছিল নিতান্তই ছেলেমানুষি। শেষ পর্যন্ত, নিশ্চয়ই নিজে নিজেই এটা বুঝে নিয়েছিল ও, আর আমি হাল্কা করে হলেও এক ধরনের গর্ব অনুভব করেছিলাম- আমার কারণেই দেরিতে হলেও ওর বাস্তব উপলব্ধি হল।

আমার বউ’কে যখন দেখলাম ব্যথায় বাঁধাকপির পাতার মত নুয়ে পড়া কাঁধ নিয়ে ব্যাল্কনির কাঁচের দরজায় গাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে নিচের ছুঁতে চলা গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে, আমার মনটা ভার লাগল। এমন স্থির নিশ্চল হয়ে সে দাঁড়িয়ে, কেবল নিশ্বাসের মৃদু শব্দ জানান দিচ্ছে, ও বেঁচে আছে; যেন সাঁড়াশির মত অদৃশ্য কোন হাত তার কাঁধ চেপে ধরে আছে, যেন শেকলে বাঁধা বিরাট লোহার বল তাকে একটা আঙ্গুলও আর নাড়াতে দিচ্ছে না।

গভীর রাতে আর খুব ভোরে, ট্যাক্সি বা বাইকের ভীষণ আওয়াজে আমার বউ চমকে জেগে উঠত ঘুম থেকে। 'মনে হচ্ছিল গাড়ি না, রাস্তা চলতেছে খুব জোরে, যেন এই বাড়িটাও ভেসে যাবে রাস্তার সাথে।' ও বলেছিল। গাড়িগুলোর শব্দ দুরে মিলিয়ে যাওয়ার পরে ঘুমে ঢলে পড়লেও আমার বৌয়ের চেহারা মরার মত ফ্যাকাসে দেখাত।

সেই রকম এক রাতে, যেন আমার বউ স্বপ্নের মধ্যে ভারী স্বরে বিড়বিড় করে বলছিলঃ 'এত সব জিনিস কোত্থেকে আসল... কোথায় যাচ্ছে?'


পরদিন সন্ধ্যায় চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাসায় ফিরে দেখি, আমার বউ এসে দাঁড়িয়েছে, হয়ত করিডোরে পায়ের শব্দ শুনে। খালি পায়ে অনেকদিন ধরে না কাটা নখগুলো জ্বলজ্বলে সাদা হয়ে আছে।

'কি বলল হাসপাতালে?'

উত্তর নেই। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আমার জুতো খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, ঘুরে দাঁড়িয়ে গাল থেকে এক গোছা শুকনো চুল সরিয়ে কানের উপর নিয়ে রাখল।

এই ভঙ্গিটা আমার চেনা, ভাবলাম আমি।

মনে পড়ে, সেই প্রথম দেখার কথা। এক বড় ভাই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে উঠে যাওয়ার পরে কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ বসে ছিলাম, হবু বউ এর মুখে কেমন যেন রহস্যময় চাহনি দেখে অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ও অনেক দুরে কোথাও হেঁটে বেড়াচ্ছে, অচেনা কোন জায়গায়। প্রথম দেখায় যে মুখ প্রাণবন্ত আর সুন্দর দেখাচ্ছিল, সেই মুখেই যেন দেখতে পারছিলাম নিঃসঙ্গতার ছায়া, যেন একদমই ভিন্ন এক মানুষ, আর সেই কারণেই মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল, মেয়েটা আমাকে বুঝতে পারে। তারপর এই ভাবনার সাথে যখন এলকোহলও মিশল, স্বীকার করে ফেলেছিলাম, সারা জীবন আমি বড্ড নিঃসঙ্গতায় ভুগেছি, আমার হবু বউ, ২৬ বছরের মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল দুরের কোন দিগন্তের দিকে। আমি দেখছিলাম তার শান্ত মুখের ভঙ্গি, ঠিক একই ভঙ্গিটাই দেখছি এখন।

'হাসপাতালে গেছ তো?' আমার বউ খুব আস্তে মাথা ঝোকাল। ও কি কিছু আড়াল করার জন্য ঘুরে দাঁড়াল, না কি আমি কোন অপরাধ করেছি?

'শোন, কথা বলছ না কেন? ডাক্তার কি বলল?'

'বলল, সব ঠিক আছে।' ও নিশ্বাস ছাড়ল না কথা বলল, ভাল বোঝা গেল না। ওর নিঃস্পৃহ কন্ঠ ভয় ধরানোর মত।

প্রথম দেখাতে ঠিক এই কন্ঠটাই আমাকে টেনেছিল সবচেয়ে বেশি। শুনলে অন্যরকম শোনাবে, কিন্তু ওর গলা মনে করিয়ে দিয়েছিল চকচকে পালিশ করা চায়ের টেবিলের কথা; এমন এক অভিজাত টেবিল যেখানে কেবল বড় অতিথিদের বসানো যায় সেরা কাপে সেরা চা ঢেলে। সেই রাতে, আমার মুখ ফসকে দেয়া নিঃসঙ্গতার জবানবন্দীতে এতটুকু বিচলিত না হয়ে আমার বউ মার্জিত গলায় বলেছিল, আর আমি কোন একটা জায়গায় স্থির হতে চাইনি কখনো।

Description

এরপর, আমি কথা বলেছিলাম গাছ নিয়ে। আমি বলেছিলাম, আমার স্বপ্ন হল ব্যাল্কনিভরা বড় ফুলের টব আর সেখানে ফুটে থাবে লেটুস আর তুলসী। গরমকালে তুলসী গাছে বিন্দু বিন্দু বরফের মত ফুল ফুটে থাকবে। আর রান্নাঘরে বেড়ে উঠবে সিম, যোগ করেছিলাম আমি। অবশেষে আমার সংশয়ী দৃষ্টির উপরে বউয়ের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল, যেন এতক্ষণ বলা গাছের গল্প আমার সাথে যাচ্ছিল না। সেই নির্দোষ ভঙ্গুর হাসির ভরসায়, আমি আবার বলে ফেলেছিলামঃ 'আমি সারা জীবন কাটিয়েছি একা।'

বিয়ের পরে, যেমনটা ভেবে রেখেছিলাম, ব্যাল্কনিতে অনেক ফুলের টব রাখা হয়েছিল, কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভাল হল না। অন্যদের বাড়িতে যে গাছ কেবল পানি পেয়ে তরতর করে বড় হয়ে উঠে, কোন কারণে, আমাদের বাসায় সেগুলো সব শুকিয়ে মরে যেতে শুরু করেছিল।

একজন বলেছিল, আমাদের ফ্ল্যাটটা জমি থেকে অনেক উপরে হওয়ায় এমন হচ্ছে; আরেকজন বলল শহরের পানি আর বাতাসের জন্য গাছগুলো মরে যাচ্ছে। এটাও শুনেছিলাম যে, প্রাণ বাঁচিয়ে বড় করার মত সদিচ্ছা আমাদের মধ্যে নেই; ডাহা মিথ্যে কথা। আমার বউ মনপ্রাণ দিয়ে গাছগুলোর যে যত্ন নিয়েছিল, অতটা আমিও পারতাম না। লেটুস বা তুলসী গাছ মরে গেলে, সারা দিন ভয়ানক বিষণ্ণ হয়ে থাকত ও; একটা কচি সবুজ পাতা গজানোর লক্ষ্মণ দেখা দিলেও, সারা দিন ও গুনগুন করে ফুর্তির গান গাইত। কিন্তু কি কারণে জানি না, চারকোণা টবগুলোতে শেষ পর্যন্ত শুকনো মাটি ছাড়া আর কিছুই রইল না। একবার ভেবেছিলাম, মরা গাছগুলো গেল কই? বৃষ্টি আসলে আমি নিজে টবগুলো এমনভাবে কার্নিশে রাখতাম, যাতে বৃষ্টির স্পর্শ ওদের জাগিয়ে তোলে; সেই দিনগুলো কোথায় হারাল!

আমার বউ আমার দিকে ফিরে বলল, 'চল দুজন মিলে দুরে কোথাও চলে যাই।' গাছগুলোর পাতাও অন্তত মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে তাজা হয়ে ওঠার লক্ষ্মণ দেখাত, কিন্তু আমার বউ বিষণ্ণতার গভীরে তলিয়ে যেতে যেতে যেন নাই হয়ে যাচ্ছিল। 'এই দম বন্ধ করা ঘরে থাকা যায় না।' ক্লান্ত হাত দিয়ে লেটুস পাতাগুলোকে বৃষ্টি থেকে আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে আর ব্যাল্কনিতে ভেজা হাত ঝাড়তে ঝাড়তে আমার বউ বলছিল। 'বৃষ্টিটাও দেখ কেমন নোংরা। মনে হচ্ছে দলা দলা কফ আর লালা!' আমার সমর্থন পাওয়ার আশায় সে তাকাল আমার দিকে। 'এটাকে বেঁচে থাকা বলে!' এক দলা থু থু ফেলল সে। 'মনে হচ্ছে, বেঁচে আছি। আসলে না।' ওর গলায় রাগ বাড়ছিল, মাতালের খিস্তির মত। 'এই দেশটা পচে গেছে! এখানে কিছুই ফলবে না, দেখছ না? এখানে থাকলে… এই দম বন্ধ করা, কান ফাটানো আওয়াজের জায়গায়!'

আমি আর সহ্য করতে পারিনি।

'কিসের দম বন্ধ?' ওর কথাগুলো যেন আমার নতুন করে খুঁজে পাওয়া টলমলে সুখের ভিত্তি নাড়িয়ে দিচ্ছিল, ঠেকিয়ে রাখা কষ্টটা ভিতর থেকে টেনে বের করে রক্তাক্ত করে দিচ্ছিল। 'বল আমাকে।' দুই হাতের তালুতে জমানো বৃষ্টির পানি ওর কাঁধে ছিটিয়ে দিয়ে বললাম, 'কিসের দম বন্ধ? কিসের কান ফাটানো?'

দীর্ঘ অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে এল আমার বউ এর মুখ থেকে, দুই হাতে ঢেকে ফেলতে চাইছিল ওর মুখ। ঠাণ্ডা বৃষ্টির ছাঁট ব্যাল্কনির কার্নিশ এ পড়ে ছিটকে এসে আমার মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছিল। সেই কার্নিশ থেকে গড়িয়ে পড়ল একটা টব। ফ্লোরে আছড়ে পড়ে চৌচির হওয়ার আগে আমার বউ এর পা ফুটো করে দিয়েছিল। মাটির দলা লেগেছিল ওর কাপড়ে। ঝুঁকে আহত পা চেপে ধরে ও নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল।

এই ঠোঁট কামড়ানোর স্বভাব ওর অনেক দিনের; বিয়ের আগেও আমি কখনো রেগে গেলে বাঁ গলা উঁচু করলে এমন করে ঠোট কামড়াত সে; চিন্তা ভাবনা গুছিয়ে নিয়ে খানিক পরেই শান্ত গলায় যুক্তি দিয়ে আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দিত এক এক করে। কিন্তু ব্যাল্কনির সেই ঘটনার পরে ঠোঁট কামড়ানো ছাড়া আর কোন জবাব পাইনি ওর কাছ থেকে। সেই দিন থেকে আমরা আর কখনই তর্ক করিনি কোন বিষয়ে।

'ডাক্তার বলছে, কোন সমস্যা নাই?' ক্লান্তি আর নিঃসঙ্গতা যেন আমাকে পেয়ে বসেছে। স্যুট খুলতেও সাহায্য করল না ও আমাকে।

'উনি কোন সমস্যা খুঁজে পাননি।' আমার বউ মুখ ঘুরিয়ে রেখেই নিশ্চিত করল।


নিজে থেকে যে দুই একটা কথাও বলত আমার বউ, সেটাও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস না করলে, কিছুই বলত না, উত্তরও দিত কেবল মাথা ঝাঁকিয়ে। গলা উঁচু করে প্রশ্নের জবাব চাইলে, ও কেবল অস্পষ্ট চোখে দুরে তাকিয়ে থাকত। ফ্লুরোসেন্ট বাতির টিমটিমে আলোতেও বোঝা যেত, তার গাইয়ের রং নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

ডাক্তার যেহেতু কোন সমস্যা খুঁজে পায়নি, হয়ত, সমস্যা ওর পেটে না, কোন ধরনের অসন্তুষ্টি কাজ করছে ওর মধ্যে। কিন্তু কিসের জন্য অসন্তুষ্টি?

গত তিন বছর ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে হাসিখুশি সময়। কাজকর্মে ঝামেলা ছিল না, বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়ানোর জন্য চাপাচাপি করেনি, নতুন ফ্ল্যাটের ব্যাংক লোন প্রায় মিটিয়ে ফেলেছি আর একটা বউ পেয়েছি যে নিজেকে অসাধারণ সুন্দরী মনে করে না কিন্তু আমি একজন সঙ্গীর কাছে যা চাই ঠিক সেই রকম; ক্লান্ত শরীরে বাথটাবে শোয়ার পরে কুসুম গরম পানি শরীরের উপর খেলা করলে যে স্বস্তি হয়, সেই রকম অনুভূতি হচ্ছিল আমার।

আমার বউ এর সমস্যাটা কি? কি পায়নি সে, যার জন্য অমন মনের অসুখ পেয়ে বসল? নিজেকেই যখন প্রশ্ন করতাম, আমার নিঃসঙ্গতা বাড়িয়ে দেয়ার কোন অধিকার কি এই মেয়ের আছে, ভয়ানক ঘৃণায় মনটা ভরে যেত, জমে থাকা ধুলার পরতের মত আমাকে আরও একাকী করে দিত।

পরের রোববার সকাল; কাল আমার ব্যবসার কাজে এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার কথা। দেখছিলাম, আমার বউ ব্যাল্কনিতে কাপড় শুকাতে দিচ্ছে। কালশিটে ততদিনে এতখানি ছড়িয়েছে যে, মনে হচ্ছে চামড়ার সাদা অংশটাই অস্বাভাবিক, নীলচে দাগের চারপাশে সাদা সাদা বুটির মত চামড়া দেখা যাচ্ছে। আমি জোরে নিশ্বাস নিলাম। খালি কাপড়ের ঝুড়িটা নিয়ে ও বসার ঘরের দিকে আসতেই আমি ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওকে বললাম কাপড় খুলতে। ও বাধা দেয়ার পরেও জোর করে টি-শার্টটা খুলে নিয়ে দেখলাম, কাঁধের কাছটা ম্লান গাড় নীলচে রং হয়ে গেছে।

একটু পিছিয়ে ওর শরীরের দিকে তাকালাম। বগলের ঘন চুলগুলো পড়ে গেছে অনেকখানি, নরম বাদামী স্তন থেকে যেন সব রং উধাও হয়ে গেছে।

'এভাবে চলতে পারে না। তোমার মা'কে ফোন করব আজকে।'

'না, ফোন কোর না। আমি করব।' হুড়মুড় করে বলল ও, এমনভাবে কথা জড়িয়ে গেল যেন নিজের জিভ চুষছিল সে।

'হাসাপাতালে যাও, বুঝছ? চর্মরোগের ডাক্তারের কাছে যাও। আচ্ছা না, জেনারেল হাসপাতালে যাও।'

নীরবে মাথা নাড়ল সে।

'তোমার সাথে যাওয়ার সময় নেই আমার, তুমি জান। নিজের শরীর নিজেই ভাল বুঝবা, তাই না?'

আবারো নীরবে মাথা নাড়ল সে।

'শোন, তোমার মা'কে কল কর।'

আমার বউ দুই ঠোঁট চেপে ধরে মাথা ঝাঁকিয়েই চলল। ও কি আসলে শুনছে কিছু? হয়ত আমার কথা এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে; মনে হচ্ছে, ওর কান থেকে কথাগুলো মেঝেতে গড়িয়ে পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি, সস্তা বিস্কুটের মত।


শব্দ করে লিফটটা খুলে গেল। অন্ধকার করিডোর দিয়ে ভারি স‍্যুটকেসটা টেনে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কলিং বেলে চাপ দিলাম। কোন উত্তর নেই।

দরজার ধাতব পাতে কান পাতলাম। বেল চাপতে লাগলাম, দুবার, তিনবার, চারবার, চেক করে দেখলাম কাজ করছে কি না বেলটা; হ‍্যা, ভেতরে বেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে, যদিও বন্ধ দরজার কারণে মনে হচ্ছিল ভেসে আসছে অনেক দুর থেকে। দরজায় স‍্যুটকেসটা ঠেস দিয়ে রেখে ঘড়িটা দেখে নিলাম। রাত আটটা বাজে। আমার বউয়ের ঘুম অবশ‍্য অনেক ভারি, কিন্তু এ তো রীতিমত বাড়াবাড়ি।

Description

খুবই ক্লান্ত লাগছে। খাওয়া দাওয়াও হয়নি। এখন আসলে চাবি খুঁজে বের করার কষ্টটাও করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

হয়ত আমার বউ মা’কে ডেকে আমার কথামত হাসপাতালে গেছে, অথবা কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গেছে। কিন্তু না- চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম ওর সব জুতা-স‍্যান্ডেল পড়ে আছে গাদাগাদি হয়ে।

জুতা খুলে স্লিপারে পা গলাতে গলাতে আনমনেই টের পেলাম ফ্ল‍্যাটটা অস্বাভাবিক শান্ত লাগছে। কয়েক পা এগুতেই নাকে একটা কটু গন্ধ এসে লাগল। ফ্রিজ খুলে দেখলাম, জুচিনি আর শশা পঁচে গন্ধ হয়ে গেছে।

রাইস কুকারের অর্ধেকটায় এখনো ভাত আছে; শুকিয়ে পাত্রের গায়ে লেগে থাকা দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে পড়ে আছে। ঢাকনাটা খুলতেই কয়েকদিনের পুরনো ভাতের গন্ধ এসে নাকে বাড়ি মারল। সিংকে জমে আছে ডিশের পাহাড় আর ওয়াশিং মেশিনের ওপর গামলায় ধুসর সাবান পানিতে ডুবে আছে কাপড়।

আমার বউ বেডরুমে নেই, বাথরুমে নেই বা অন‍্য রুমেও নেই। ওর নাম ধরে ডাকলাম; উত্তর নেই। বসার ঘরে সপ্তাহখানেক আগে রেখে যাওয়া পত্রিকা ছড়ানো; একটা খালি দুধের কার্টন; তলানিতে কয়েক ফোঁটা দুধ নিয়ে একটা কাঁচের গ্লাস; উল্টো করে রাখা আমার বউয়ের মোজা; আর লাল চামড়ার পার্স; সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ির শব্দে রুমের ভিতরে জমে থাকা নিস্তব্দ্ধতায় যেন চিড় ধরল।

খুব ক্ষুধা আর ক্লান্তি লাগছিল বলে, সব প্লেট সিংকে পড়ে ছিল বলে, ভাত তোলার মত একটা ধোয়া চামচও ছিল না বলে, আমার খুব নিঃসঙ্গ বোধ হল। অনেক দুর জার্নি করে এসে খালি ঘরে ঢুকে ফ্লাইটে ঘটা নানা ছোটখাটো ঘটনা, বিদেশে ট্রেনের জানলায় পেছনে ছুটে যাওয়া দৃশ‍্যগুলোর কথা বলতে চাইছি বলে, ‘তুমি কি ক্লান্ত?’ বলার কেউ নেই বলে, নিজের পুরুষত্ব দেখিয়ে নির্বিকারভাবে ‘আমি ঠিক আছি’ বলার সুযোগ হারিয়েছি বলে, আমার নিঃসঙ্গ বোধ হল। নিঃসঙ্গতার কারণে আমার রাগ হল। নিজেকে তুচ্ছ মনে হওয়ায়, গায়ে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগায়, নিজের ভাল থাকা নিয়ে নিজেকে ধোঁকা দেয়ায়, আমার রাগ হল। একাকী, কেউ ভালবাসার নেই, জীবনের অস্তিত্ব যেন এর মধ‍্যেই নিভে গেছে।

ঠিক সেই সময় দুর্বল একটা কন্ঠ কানে এল।

শব্দের উৎসের দিকে ফিরলাম। আমার বউ এর গলা। ব‍্যাল্কনি থেকে ভোসে আসা মৃদু কন্ঠ, বোঝা দুঃসাধ‍্য।

সাথে সাথে, ভয়ংকর নিঃসঙ্গতা বদলে গিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, আর ব‍্যাল্কনিতে পা দিয়েই যেন আমার মুখ ছুটতে চাইল। ‘এখানে বসে আছ! আমি ডাকছি যে শুনতে পাও নাই!' বেশ জোরে ধাক্কা দিয়ে বারান্দার দরজা খুললাম। 'এভাবে সংসার চলে? কি কর তুমি?'

আমার বউ এর নগ্ন শরীর দেখে থমকে গেলাম।

ব্যাল্কনির গ্রিলের দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাত এমন করে তুলে রেখেছে, যেন আনন্দ করছে। তার পুরো শরীর গাড় সবুজ হয়ে উঠেছে। আগে যে মুখটা ছায়া ছায়া ছিল, সেটা এখন চকচকে চিরহরিৎ পাতার মত হয়ে গেছে। শুকনো মুলা-পাতার মত চুলগুলো হয়ে উঠেছে রঙ্গিন বুনো পাতার মত দীপ্তিময়। সবুজ মুখে ফিকে আলোয় ঝলমল করছিল চোখজোড়া। আমার দিকে ও ফিরে তাকিয়ে উঠে বসার ভঙ্গি করতেই নিজের অজান্তে একটু পিছিয়ে গেলাম। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল না উঠতে বা হাঁটতে পারবে।

ওর পাতলা কোমর মুচড়ে গেছে। গভীর নীল ঠোটের মাঝে ঝুলে পড়া জিভটা পাতার মত দুলছে। কোন দাঁতই দেখা যাচ্ছে না।

কুঁচকানো ফিকে দাগওয়ালা ঠোঁট থেকে ছোট চিৎকার বেরিয়ে এল।

'... পানি।'

দৌড়ে সিংকের কাছে গিয়ে বড় গামলা ভরে পানি ভরে নিলাম। ব্যাল্কনির দিকে তাড়াহুড়ো করে যেতে যেতে পানি উপচে পড়ে বসার ঘরের মেঝে ভিজে গেল। যখুনি আমার বউ এর বুকে সেই পানি ছিটালাম, অমনি ওর সারা শরীর যেন বড় গাছের পাতার মত কাঁপতে কাঁপতে নতুন জীবন পেল। ওর চুল হঠাত খাড়া হয়ে গেল, যেন অদৃশ্য কিছু এতক্ষণ চেপে বসে ছিল। দেখলাম ওর ঝলমলে সবুজ শরীরটা নতুন করে ফুটে উঠল। কেমন যেন মাথা ঘুরে উঠল আমার।

আমার বউ'কে এত সুন্দর আর কখনই লাগেনি।


মা,

তোমাকে চিঠি লেখার কিংবা তোমার রেখে যাওয়া সুয়েটার পরার সাধ্য আর আমার নেই। সেই যে গত শীতে এসে যে ভুলে ফেলে গিয়েছিলে, সেই কমলা সুয়েটারটা।

ও ব্যবসার কাজে বাইরে যাওয়ার পরদিন ওটা পরেছিলাম। আমার যে কেমন ঠাণ্ডা লাগে, তুমি তো জান।

ধোয়া হয়নি, তাই তোমার গায়ের গন্ধ এখনো লেগে আছে। অন্য দিন হলে, আগে ধুয়ে নিতাম, কিন্তু খুব ঠাণ্ডা পড়ল, আর তা ছাড়া ঐ গন্ধে একটু শ্বাস নিতে চাইলাম। তাই ওটা পরে ফেললাম, ঘুমাতেও গেলাম ওটা পরে। পরদিন, কুয়াশার মুঠি তখনো সরেনি, আর আমারও হয়ত খুব ঠাণ্ডা আর তৃষ্ণার্ত ছিলাম, শোবার ঘরের জনালা দিয়ে রদ দেখামাত্র আমার ভিতর থেকে সেই চাপা চিৎকার বেরিয়ে এলঃ মা। ঐ উষ্ণ আলো জড়িয়ে ধরার জন্য, ব্যাল্কনিতে গিয়ে আমি সব কাপড় খুলে ফেললাম। সুর্যের আলো ঢুকে পড়ছিল আমার খোলা গায়ে, যেখানে তোমার গন্ধ। হাঁটু গেড়ে বসে বারবার কেবল বলছিলাম- মা, মা। আর কোন শব্দ না।

কত সময় গেছে, জানি না। দিন, সপ্তাহ, মাস? যখন বাতাস আর তেমন গরম লাগছিল না। একবার মনে হচ্ছিল তাপ বেড়ে যাচ্ছে, আবার মনে হচ্ছে, না, কমে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে, নদীর ওপারে ফ্ল্যাটগুলোর জানলায় কমলা রঙের আলো জ্বলে উঠবে।

ওখানে যারা থাকে, তারা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে? রাস্তায় হেডলাইটের আলও ছড়িয়ে যারা গাড়ি নিয়ে ছুটছে, তারা? আমাকে কেমন দেখাচ্ছে এখন?


ওর মনটা বড় নরম। একটা বড় টব কিনে আমাকে ওখানে পুতে দিয়েছে। রোববার, সারা সকাল ব্যাল্কনির শেষ মাথায় বসে ও সবুজ পোকা তাড়ানোর চেষ্টা করে।

আগে সব সময় ও খুব ক্লান্ত থাকত, এখন সে-ই আমাদের বিল্ডিঙের পিছনের পাহাড়ে উঠে প্রতি সকালে, আর ফিরে পাহাড় থেকে আনা মগভর্তি মিনারেল ওয়াটার নিয়ে, আমার পায়ে পানি দিবে বলে (ওর মনে আছে, আমি টেপের পানি পছন্দ করি না)। কিছুক্ষণ আগে, ও আমার টবের মাটি পাল্টে দিয়েছে। গত রাতের বৃষ্টি, শহরের বাতাসের ময়লা খানিকটা দুর করে দেয়ায়, ও দরজা জানলা খুলে দিয়েছে ঘরে বাতাস ঢোকার জন্য।


অদ্ভুত লাগে, মা। কোন কিছু দেখছি না, শুনছি না, ঘ্রাণ পাচ্ছি না, স্বাদ পাচ্ছি না, তবু সব কেমন তাজা লাগছে, প্রাণবন্ত লাগছে। নুড়ি ফেলা রাস্তায় ঘষা খাচ্ছে গাড়ির টায়ার, দরজা খুলে ও আমার দিকে আসার সময় পায়ের শব্দে কাঁপন উঠছে, ভোরের আলোয় বৃষ্টি ধোঁয়া বাতাস স্বপ্নে ভরে উঠছে- আমি টের পাই।

আমি বুঝতে পারি- দুরে ও কাছে কুড়ি ফুটছে আর পাপড়ি মেলছে, লার্ভা থেকে প্রজাপতি হচ্ছে, কুকুর বিড়ালের বাচ্চা হচ্ছে, পাশের বিল্ডিঙের বুড়োটার নাড়ি চলছে আর থামছে, ওপরের রান্নাঘরে শাকভাজি হচ্ছে, নিচের ফ্ল্যাটে গ্রামোফোনের পাশে ফুলদানিতে ছিঁড়ে আনা ক্রিসেন্থিয়াম রাখা হচ্ছে। দিনে কি রাতে তারারা ভেসে থাকে, প্রতিবার সূর্য উঠলে রাস্তার ধারের সিকামোর গাছের ক্ষুধার্ত শরীর পুব দিকে ঝুঁকে যায়। আমার শরীরও ঠিক একইভাবে কাজ করছে।

বুঝতে পারছ তুমি? কিছুদিনের মধ্যে, জানি, আমি আর চিন্তাও করতে পারব না, কিন্তু তাতে কোন অসুবিধা নেই। শুধু বাতাস, রোদ আর পানিতে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি আমি অনেকদিন ধরে।


মনে পড়ে, সেই ছোটবেলায় রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে তোমার স্কার্টে মুখ লুকালে কেমন মিষ্টি একটা গন্ধ পেতাম; তিলের তেল বা তিলের দানা ভাজার গন্ধ। তুমি তো জান, সব সময় আমি মাটিতে হাত রাখতে চাইতাম। আমার মাটি মাখা হাত লেগে তোমার স্কার্টের হেম নোংরা হয়ে যেত।

কত ছিল আমার বয়স তখন? সেই বসন্তের দিন বৃষ্টিতে ধোয়াটে হয়ে ছিল, বাবা আমাকে পাওয়ার টিলারের ওপর বসিয়ে সাগর পাড়ের দিকে চালিয়ে যেত। রেইনকোট পরা বুড়োরা হাসত বেখেয়ালে, বাচ্চাদের ভেজা চুল সেঁটে থাকত কপালের সাথে , নাচত লাফাত, ওদের মুখগুলো ধীরে ধীরে ঝাপ্সা হয়ে যেত।

সাগর পাড়ের ঐ গরীব শহরটা ছিল তোমার জগত। ওখানে জন্মেছ, বড় হয়েছ। জন্ম দিয়েছ, কাজ করেছ, বুড়ো হয়েছ।

Description

এক সময় ওখানেই পারিবারিক গোরস্থানে তোমাকে বাবার পাশে শুইয়ে দেয়া হবে।

তোমার মত জীবন হওয়ার ভয়, মা গো, আমাকে বাড়ি থেকে দুরে ঠেলে দিয়েছে। সতেরো বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে বুসান, ডায়েগু, গ্যাংনেউং এর মত শহরে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি এখনো মনে আছে। জাপানিজ রেস্টুরেন্টে বয়স লুকানো, একা একা সব কাজ করা, হাঁটু মুড়ে বসে থাকা পড়ার ঘরে সন্ধ্যা নেমে আসা- খুব দারুণ লাগত জায়গাটা। বড় শহরের চোখ ধাঁধানো আলো, সেখানকার মানুষের জ্বলজ্বলে গ্ল্যামার।

জানি না কখন প্রথম মনে হোল এই সব অচেনা মানুষের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আমি বুড়ো হয়ে শেষ হয়ে যাব। বাড়িতে আমি অসুখী ছিলাম, অন্য জায়গাতেও তাই, তাহলে বল তো, আমি কোথায় যাই?

কখনই ভাল ছিলাম না। আমার কাঁধে কি কোন অসুখী আত্মা ভর করে আছে, চেপে ধরে আছে গলা, আমার হাত পা? সব সময় কান্না, ব্যথা বা চিৎকার থেকে পালাতে চেয়েছি। বাসের পিছনে হাঁটু উঁচু করে এমনভাবে বসে থাকতাম যেন একটা মাছিও মারতে পারি না আমি, কিন্তু সারাক্ষণ ইচ্ছে হত ঘুষি মেরে জানলার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলার।

হাত কেটে তালুতে গড়ানো রক্তের জন্য লোভ হত, বিড়াল যেমন দুধ চেটে খায় আমিও তেমনি খেতাম হয়ত। কার থেকে আমি পালানোর চেষ্টা করতাম, কি যন্ত্রণায় মনে হত দুনিয়ার আরেক প্রান্তে পালিয়ে যাই? আর কি-ই বা আমাকে টেনে রাখত, ভেঙ্গে ফেলত, গুড়িয়ে দিত? কোন এক শেকল আমাকে বেঁধে রেখেছিল, যাতে এই শরীরের এই বদ রক্ত বদলে নেয়ার জন্য কিছুই করতে পারিনি?


বুড়ো ডাক্তার কিছুক্ষণ পর পর স্টেথেস্কোপ আঙ্গুল দিয়ে ঠুকতে ঠুকতে বলে যাচ্ছিলেন, আমার ভিতরটা না কি কবরের মত নীরব। ওখানে কেবল শোনা যায় অনেক দুরের বাতাসের শিসের মত শব্দ। স্টেথেস্কোপ টেবিলে রেখে তিনি ফিরলেন আল্ট্রাসাউণ্ড মনিটরের দিকে। আমার পেটের ওপর শীতল জেল মাকছিলেন আমি স্থির ছিলাম। তার হাতের লাঠির মত একটা যন্ত্র খুব নিয়মমাফিক আমার পাঁজর থেকে তলপেট পর্যন্ত নামছিল। ঐ যন্ত্র, মনে হয়েছিল, আমার ভিতরের সব ছবি মনিটরে সাদাকালো করে দেখিয়ে দিচ্ছিল।

'সব ঠিক আছে,' উনি জিহ্বা দিয়ে শব্দ করে মৃদু স্বরে বললেন। 'এই যে তোমার অন্ত্র… এখানে কোন সমস্যা নেই।'

সব কিছুই ছিল 'স্বাভাবিক'।

'পাকস্থলী, লিভার, জরায়ু, কিডনি, সব ঠিক আছে।'

উনি কেন দেখতে পেলেন না, এই সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে, কিছুদিন পরে উধাও হয়ে যাবে? টিস্যু দিয়ে বেশিরভাগ জেল ঘষে ঘষে তুলে ফেলে যখন উঠে বসতে চাইলাম, উনি আমাকে আবার শুতে বললেন। পেটের নানা জায়গায় হাতের চাপ দিলেন; তেমন ব্যথা লাগল না। চশমা পরা মুখের দিকে তাকিয়ে তার নির্বিকার প্রশ্ন শুনলাম, 'ব্যথা লাগছে?' মাথা দুই দিকে নেড়ে জানালাম, না।

'এখানে ঠিক আছে?'

'এখানে ব্যথা লাগছে না?'

'ব্যথা লাগছে না।'

একটা ইনজেকশন নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় আবার বমি হল। সাবওয়ে স্টেশনে বসে পড়ে পিছনের টাইলস বসানো দেয়াল আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছিলাম। ব্যথা কমানোর জন্য মনে মনে গুনছিলাম। জান, ডাক্তার বলে দিয়েছিল, আরাম করতে, শান্তির চিন্তা করতে। সব গিয়ে পড়েছে মনের ওপর, বৌদ্ধ মাস্টারদের ঢঙ্গে উনি কথা বলেছিলেন। শান্ত চিন্তা, আরামের চিন্তা, এক, দুই, তিন, চার, চিরশান্তি, বমি না আসার জন্য সংখ্যা গোনা… ব্যথায় আমার চোখে পানি চলে এসেছিল, পাকস্থলীর এসিড বারবার বমি হয়ে বেরুনোর কারণে শরীরে খিচুনি হচ্ছিল, তারপর এক সময় যখন বের হওয়ার আর কিছু বাকি ছিল না, আমি মেঝেতে ডুবে গেলাম। মাটিটাও এমন কাঁপছিল, অপেক্ষা করছিলাম, কখন থামে হতচ্ছাড়া মাটি।

কতদিন আগে ছিল সেটা?


মা, আমি প্রায়ই একই স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি, পপলার গাছের মত আমি লম্বা হয়ে গেছি। ব্যাল্কনির ছাদ আর ওপরতলার মেঝে ফুঁড়ে, পনেরোতলায়, ষোল তলায়, কংক্রিট আর রড ভেদ করে ছাদ ছাড়িয়ে যাচ্ছি। আমার সবচেয়ে উঁচু ডালে সাদা পোকার মত ফুলেরা ফুটে আছে। আমার শ্বাসনালী দিয়ে পানি ঢুকে এমনভাবে ফুলে যাচ্ছে, যেন যে কোন সময় ফেটে যাবে, আমার বুক ঠেলে উঠেছে আকাশের দিকে আর আমি সব শাখা প্রশাখা টানটান করার চেষ্টা করছি। কেবল এইভাবে এই ফ্ল্যাট থেকে আমি পালাতে পারি। প্রতি রাতে, মা, প্রতি রাতে এই একই স্বপ্ন।


দিনে ঠাণ্ডা বাড়ছে; আজকেও, অনেক পাতার মাটিতে ছিঁড়ে পড়ার দৃশ্য, অনেক সাপের খোলস পালটানোর দৃশ্য, অনেক পোকামাকড়ের জীবনের শেষ আর অনেক ব্যাং এর সময়ের খানিক আগে শীতনিদ্রায় যাওয়ার দৃশ্য দেখবে দুনিয়া।

আমার কেবল তোমার সুয়েটারের কথা মনে পড়ে। তোমার স্মৃতির গন্ধ এখন আর অত স্পষ্ট না। আমি ওকে বলতে চেয়েছিলাম, সুয়েটারটা আমার ওপর বিছিয়ে দিতে, কিন্তু গলায় আমার আর স্বর নেই। কি করব বল? এইভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখে ও কান্না করে, রেগেও যায়। তুমি তো জান, পরিবার বলতে ওর কেবল আমিই ছিলাম। আমার ওপর ঢেলে দেয়া মিনারেল ওয়াটারে মিশে থাকা কান্নার জলটা আমি ঠিক টের পাই। আমি বুঝি, শূণ্যে ছোঁড়া ওর লক্ষ্যহীন ঘুষিতে বাতাসের কণাগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।


ভয় করে, মা। আমার অঙ্গগুলো খসে পড়বে। এই টবটা বড় আঁটোসাঁটো, দেয়ালগুলো বড্ড শক্ত। আমার শিকড়ে ব্যথা লাগে। মা, শীতের আগেই আমি মরে যাব।

আর কখনই এই পৃথিবীতে ফুটে উঠব না।


ব্যবসার কাজ সেরে ফেরা সেই রাতে আমার বউ এর গায়ে তিন গামলা পানি ঢালার পরে, পাকস্থলীর এসিড উগরে দিলে সে। আমি চোখের সামনে দেখছিলাম, ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে আবার বন্ধ হচ্ছে। কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলে ম্লান দাগওয়ালা সেই ঠোঁটে হাত দিয়ে, অবশেষে দুর্বল একটা কন্ঠ শুনতে পেলাম, এতই মৃদু সেই গলা যে কি বলছে কিছুই বুঝতে পারিনি। আমার বউ এর গলা সেটাই শেষ শোনা। এরপরে গোঙ্গানিও ছিল না তার মুখে।

Description

ওর উরুর ভিতরের দিকে শিকড় বেরিয়েয় এসেছে। বুকে ফুটেছে গাড় লালা রঙের ফুল। গোড়ায় মোটা- হলদে আর প্রান্তে সাদা জোড়া কেশর বেরিয়ে আছে ওর স্তনজোড়া থেকে। ওর তুলে রাখা হাত যখন সামান্য চাপ দিতে পারছে, তখন আমার বউ আমার ঘাড় জড়িয়ে ধরতে চাইল। ওর ম্লান আলো অবশিষ্ট থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে, আমি ঝুঁকে জুই ফুলের পাপড়ির হাতের আলিঙ্গনে নিজেকে জড়লাম। 'ঠিক আছ?' জিজ্ঞেস করলাম। ওর চোখ এক জোড়া পাকা আঙ্গুর; মসৃণ চকচকে, ওখানে হাসির ভুত জমে আছে।

শরতের মাঝে দেখলাম, একটা কমলা আলো আমার বউ এর শরীর রাঙ্গিয়ে দিয়েছে। জানলা খুলে দিতেই বাতাসে ওর তুলে ধরা হাত নড়ে উঠল।

শরত যখন ফুরিয়ে আসল, দুটো তিনতে করে ওর পাতা ঝরতে লাগল। ওর গায়ের কমলা রং পাল্টে ফ্যাকাসে বাদামী হয়ে গেল।

আমার মনে পড়ল, বউ এর সাথে আমার শেষবার ঘুমানোর কথা। শরীরের ফ্লুইডের তেতো গন্ধের বদলে, আমার বউ এর শরীরের নিচ দিক থেকে হাল্কা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিল। সেই সময় আমি ভেবেছিলাম, হয়ত সে সাবানের ব্র্যান্ড বদেলছে, অথবা সময় পেয়ে ওখানে কোন পারফিউম দিয়েছে। কতদিন আগে সেটা?

এখন তার আকৃতি আর আগের মত নেই। ওর চকচকে গোল আঙ্গুর হয়ে যাওয়া চোখের মনিতে বাদামী শিরা দেখা যায়। আমার বউ আর দেখতে পায় না। ও নিজের ডালও আর নাড়াতে পারে না। কিন্তু ব্যাল্কনিতে গেলেই এমন অনুভূতি হয় আমার যার কাছে হাড় মেনে যায় সব ভাষা, যেন ওর থেকে কোন বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বেরিয়ে আমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে। আমার বউ এর এক সময়ের হাত আর চুল পাতা হয়ে ঝরে ঝরে গেল, আর যেখানে তার ঠোঁট ছিল, সেটা হা হয়ে কয়েকটা ফল বেরিয়ে এসেছে। তখন আমাদে মধ্যে যোগাযোগটাও বন্ধ হয়ে গেল।

ছোট ফলগুলো ডালিমের মত বড় হয়ে উঠল; আমি হাত দিয়ে ওদের পেড়ে নিলাম আর ব্যাল্কনি আর বসার ঘরের মাঝখানে বসলাম। এই রকম হলদে সবুজ ফল জীবনে প্রথম দেখছি। বিয়ারের সাথে দেয়া সুর্যমুখী ফুলের বিচির মত শক্ত ফলগুলো।

একটা তুলে নিয়ে মুখে দিলাম। খোসার ছিদ্র দিয়ে টের পেলাম, গন্ধ বা স্বাদের কোন বালাই নেই। কামড় বসালাম। এই দুনিয়ায় আমার একমাত্র নারীর ফলে। প্রথম যে স্বাদটা টের পেলাম, সেটা এসিডিক, প্রায় মুখ পোড়ানো। আর যে রসটা জিহ্বায় গেল, সেটা তেতো।

পরদিন আমি এক ডজন ছোট গোল টব কিনে নিয়ে উর্বর মাটি দিয়ে ভরিয়ে ফেললাম, তারপর সেই ফল দিয়ে দিলাম টবগুলোতে। ওগুলোকে লাইন ধরে রাখলাম আমার হারিয়ে যাওয়া বউ এর পাশে, তারপর জানলা খুলে দিলাম। রেলিং এ ঝুঁকে সিগারেট খেলাম, প্রাণ ভরে আমার বউ এর শরীরের নিচের দিকে গজানো ঘাসের ঘ্রাণ নিলাম। শেষ শরতের ঠাণ্ডা বাতাস আমার সিগারেটের ধোয়া আর লম্বা চুলগুলো নিয়ে খেলছিল।

বসন্ত আসলে কি আমার বউ আবার অঙ্কুরিত হত? ওর গায়ে কি আবার লাল ফুল হত? আমি জানতাম না।

পড়ে দেখতে পারেন