সাহিত্যে যত রূপকঃ থাকে কেবলই ছবি

Allegory
নরম নদী বলে তো কিছু নাই? তা হলে কেমন হলে একটা নদীকে নরম দেখাতে পারে?

সেই পুরনো বিষয়। মানুষকে কিছু জানানো আসলে কি জরুরি?

মানে, আমি দার্শনিক বা রাজনৈতিক কোন বিষয়ের কথা বলছি না; সাহিত্য অর্থে।

কেউ যখন একটা গল্প লিখে, আর কেউ যখন একটা প্রবন্ধ লিখে- দুইটার উদ্দেশ্য তো দুই রকম, তাই না? প্রবন্ধে নিজের জগত তৈরির কোন সুযোগ থাকে না। যা বলার, স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে। আর কবিতা, গল্প বা উপন্যাসের একটা আপাত স্বাধীনতা আছে। এই স্বাধীনতা কথাটা যেমন বিমূর্ত, তেমনি তার জগতটা।

এই জগতে কেউ সূর্যকে পূর্ব দিকে তুলতে পারে, তারপর সেটাকে উত্তর দিকে নিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু কেন করবে সেটা?

এটার একটা উত্তর হতে পারে, যে কারণে মানুষ তার অনতিক্রমযোগ্য সীমাবদ্ধতাকে সব সময় অতিক্রম করতে চায়। যেমন, আমি টাইম ট্রাভেল করতে পারি না বলে আমি ভাবি, কি হয় যদি আমার নায়ক টাইম ট্রাভেল করে? তারপর আমি তত্ত্বগত ভাবে জানি যে, যে মহাশূন্যে ঘুরে এলো, তার কাছে সময়ের গতি কম হবে। আমি কল্পনায় দুইটা মানুষের কথা চিন্তা করলাম- একজন টাইম ট্রাভেল করে বেড়াচ্ছে আর আরেকজন তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।

এতটাই লাগামহীন জগত তৈরি করে নেয় সাহিত্য!

একটা লেখায় কথা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, হয়ত, ছবি। কী ছবি আঁকা হচ্ছে?

এক ধরনের ছবি আছে, যেটা চিন্তা করা সহজ এবং খুব কমিউনিকেটিং।

বুদ্ধদেব বসুর এই কবিতাটা ধরা যাক-

"কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়,

কেমন করে বলি!

কী নির্মল নীল এই আকাশ,

কী অসহ্য সুন্দর!

যেন গুণীর কণ্ঠে অবাধ উন্মুক্ত তান,

দিগন্ত থেকে দিগন্তে।

কী ভালো আমার লাগল এই আকাশের দিকে তাকিয়ে।

চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা,

কুয়াশায় ধোঁয়াটে,

মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।

তুমি কাছে এলে,

একটু বসলে,

তারপর গেলে ওদিকে,

ইস্টিশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তা-ই দেখতে।

গাড়ি চলে গেল।

- কী ভালো তোমাকে বাসি,

কেমন করে বলি!

আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায় না।"


একদম সহজ সাধারণ বর্ণনা। কিন্তু সেই সহজের মধ্যেও কি সুন্দর! এবার জীবনানন্দের একটা কবিতা মেলাই-

"আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,

দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল

কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়

তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল

জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে

চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,

খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার:

পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!

বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার

গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক;

আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক;"

এখানে প্রচুর রূপক, আমাদের অভিজ্ঞতাকে চ্যালেঞ্জ করছে।


নরম নদী বলে তো কিছু নাই? তা হলে কেমন হলে একটা নদীকে নরম দেখাতে পারে? এটা কি বিকেলের নরম আলো তে নদীকে যেমন লাগে, সেই রকম? সেখানে একজন নারী আবার কুয়াশার ফুল ছড়াচ্ছে। তা হলে কি এমন যে, একজন নারী কুয়াশার মধ্যে নাচছে? তার নাচের মুদ্রায় কেটে কেটে যাচ্ছে কুয়াশা? চোখ বন্ধ করলে কী চমৎকার একটা ছবি ভেসে ওঠে ভেবে দেখ মনি। গোধূলির ক্লান্ত আলোতে মাঠে ভেসে থাকা হাল্কা কুয়াশার মাঝে একজন নারী আপন মনে দুলে দুলে নেচে যাচ্ছে।

এমনি করে প্রতিটি লাইন এই একটা ছবি। চোখ বন্ধ করে সেই ছবির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার আনন্দ।

অনেকেরই আমাদের শহীদুল জহির পছন্দ না! তার লেখা না কি জটিল লাগে। কিন্তু যেহেতু ঐ মানুষদেরই আবার অনেকর মারকেজ'কে ভাল লাগে, ওর সাথেই একটা ছোট্ট তুলনা করা যাক।

ধরা যাক, মারকেজ এর 'লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা'।

লাইনগুলো কিন্তু কবিতার মত-

Behind her, so close to her ear that only she could hear it in the tumult, she heard his voice:

“This is not the place for a crowned goddess.”

She turned her head and saw, a hand’s breadth from her eyes, those other glacial eyes, that livid face, those lips petrified with fear, just as she had seen them in the crowd at Midnight Mass the first time he was so close to her, but now, instead of the commotion of love, she felt the abyss of disenchantment. In an instant the magnitude of her own mistake was revealed to her, and she asked herself, appalled, how she could have nurtured such a chimera in her heart for so long and with so much ferocity. She just managed to think: My God, poor man! Florentino Ariza smiled, tried to say something, tried to follow her, but she erased him from her life with a wave of her hand.

“No, please,” she said to him. “Forget it.”


অনুবাদ চেষ্টা করলে দাঁড়ায়-

"মেয়েটার পিছে, তার কানের খুব কাছে সে শুনতে পায় গুঞ্জনের মত, সেই ছেলেটার গলা-

'এখানে তো মুকুট পরা দেবীদের জন্য কোন জায়গা নেই!'

মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, তার চোখের এক হাতের মধ্যেই, সেই শীতল চোখজোড়া, সেই ক্ষুব্ধ মুখ, ভয়ে স্থির ঠোট, যেমনটা গভীর রাতের ভিড়ের মধ্যে প্রথম দেখায় মেয়েটার চোখে পড়েছিল, কিন্তু এখন, ভালবাসার মোহের বদলে তার মনে জেগে ওঠে গভীর নিরাসক্তি। এক মুহূর্তেই তার নিজের ভুলের তীব্রতা পরিষ্কার হয়ে যায় নিজের কাছে, আর সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, ভয়ার্ত হয়ে, কীভাবে সে এত দিন ধরে অসম্ভব কল্পনা নিজের মনের ভেতর লালন করেছিল এবং সেই রকম মরীয়া হয়ে। কেবল এতটুকুই সে চিন্তা করতে পারেঃ খোদা, বেচারা লোকটা!"



কেমন জটিল বাক্য, কেমন আপাত দুর্বোধ্য একটা প্রকাশ। হ্যাঁ, এটুকুই কেবল পরিচিত মনে হতে পারে যে, মেয়েটার এই অনুভূতি আমি হয়ত চিনি।

এইবার এই লাইনগুলো দেখা যাক-

‘তখন একদিন সুপিয়া আকতার যেন কোথায় গেছিল, গেলে ফিরা আসতে হয়, তাই কোত্থেকে যেন সে ফিরা আসে; তার পরনে বোধহয় শাড়ি অথবা হয়তো সালোয়ার কামিজই ছিল, সঙ্গে যেন কে, হয়তো তার আম্মা, না হয় দাদি আম্মা।’


এই লাইনগুলোর সাথে মারকেজ এর মিলটা কি চোখে পড়ে? জটিল বাক্য (মারকেজ এর থেকে কম অবশ্য), এবং সংশয়। এই ধরনের সংশয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ত! কেননা, আধুনিক যুগে, সবাই নিজের মত নিয়ে খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী। আর একজন লেখক যখন এই ব্যাপারটা তুলে ধরেন যে, কি ভাবে এত নিশ্চিত হলে? আচ্ছা, ওই রকম কি হতে পারে না! বা অন্য রকম!

আবার গানের কথা বললে, কোহেন এর লিরিক অনেকের এতো ভাল লাগে কেন?

"I wonder how many people in this city

live in furnished rooms.

Late at night when i look out at the buildings

I swear I see a face in every window

looking back at me

and when I turn away

I wonder how many go back to their desks

and write this down."

পরিচিত একটা ছবির মধ্যে কী যেন একটা ঢুকিয়ে দিল সে, তাই না? এবার আবার জীবনানন্দ খুঁজলে দেখা যাবে-

"অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো,

অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিলো,

মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিলো অনেক;

অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো,

অনেক কমলা রঙের রোদ;

আর তুমি ছিলে;

তোমার মুখের রূপ কতো শত শতাব্দী আমি দেখি না,

খুঁজি না।"



এই যে, কমলা রঙের রোদ এতবার করে যে বলল, সেটা কী কারণে? এই আকুতিটাই শেষের লাইনটাকে অত মারাত্মক করে তুলেছে। একটা মোহগ্রস্ত মানুষ যেমন করে, তেমন করে একজনের হাহাকার শুনতে পাচ্ছি যেন!

তো মানুষের জন্য শেষ পর্যন্ত আর কোন মেসেজ থাকল না। থাকল কিছু ছবি মাত্র। কিংবা হয়ত থাকল, মেসেজ আমারা চাই বা না চাই, থাকবেই হয়ত।

পড়ে দেখতে পারেন