ছক কাটা নজরদারির যুগে পরিচয় নির্মাণ

Asad_USA
আপাত অর্থে আমাদের পারফরম্যান্সের পরিচালক হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম।

এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, পরিচয় বড় গোলমেলে হয়ে গেছে।

এলগরিদমে আমাদের পরিচয় সামনে আসে; আমাদের বিচার হয় লাইক, শেয়ার আর কমেন্ট দিয়ে।

পরিচয় হয়ে গেছে চশমা বদলের মত ব্যাপার।

কে কোন চশমা দিয়ে দেখছে, তাই দিয়ে বদলায় ব্যক্তিকে নিয়ে ব্যাখ্যা বা দৃষ্টিভঙ্গি। আর আমরাও প্রতিটা ডিজিটাল ইন্টারএকশনে পাল্টাই নিজেদের।

কিভাবে? তিন দার্শনিকের শরণ নেয়া যাক।

গফম্যান এর কথা মনে আছে তো? তিনি বলতেন, জীবনটাই হল পারফরম্যান্স।

বোডরিলার বলতেন, হাইপার রিয়েলিটি বা ‘অতিবাস্তবতার’ কথা।

আর ফুকো শিখিয়েছিলেন নজরদারি সমাজের তত্ত্ব।

এই তিন তত্ত্ব মিলালে দেখা যাবে, আমরা সবাই নিজেদের অ্যাভাটার হয়ে গেছি। নেট দুনিয়ার সীমাহীন মঞ্চে আমরা নিজদের শিখিয়ে পরিয়ে নিচ্ছি, খাপ খাইয়ে নিচ্ছি, পারফর্ম করে চলেছি।



ডিজিটাল আয়না

সামাজিক মাধ্যম এসে মঞ্চ ছড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বে। এখানে সবাই একইসাথে তিন ভুমিকায় কাজ করে- অভিনেতা, নির্দেশক আর দর্শক।

আগে পরিচয় তৈরি হত কিভাবে?

অভিজ্ঞতা দিয়ে, সম্পর্ক দিয়ে বা নিজেকে নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।

সেই জায়গা নিয়েছে এখন ইন্সটগ্রাম, ফেসিবুক বা ইউটিউবের ফিড আর কমেন্ট বক্স। নিজের ইমেজ এখানে তৈরি করতে হয় অনেক যত্ন করে, ট্রেন্ড এর সাথে মিলিয়ে। আগে দার্শনিক প্রশ্ন ছিল- আমি কে? আর এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে- মানুষ আমাকে কিভাবে দেখছে? এই যে পরিবর্তন, এটা কিন্তু কেবল প্রযুক্তির ব্যাপার না; বরং selfhood বা আত্মসত্তার মৌলিক সংস্কার।

সমাজ বিজ্ঞানী এরভিং গফম্যান মনে করে, সমাজ কি চায় সেই অনুযায়ী ব্যক্তি সামাজিক পারফরম্যান্স এর মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করে।

সামাজিক মাধ্যম আসার আগে, এই পারফরম্যান্স ছিল ছোট ছোট সামাজিক পরিসরে- পরিবারের মধ্যে, বন্ধুদের মধ্যে, অফিসে কলিগদের মধ্যে। সামাজিক মাধ্যম এসে মঞ্চ ছড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বে। এখানে সবাই একইসাথে তিন ভুমিকায় কাজ করে- অভিনেতা, নির্দেশক আর দর্শক।

মুশকিল হল, এই পারফরম্যান্সের কোন শেষ নেই।

থিয়েটারে অভিনেতারা একটা বিরতি পায়, এখানে সেই সুযোগ নেই। পরিচয় হয়ে গেছে ব্র্যান্ডের মত, বাজার অনুযায়ী দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাকে সব সময় নানা কৌশলের কথা ভাবতে হয়। মানুষের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নিজের আসল পরিচয়কে ঠেলে দিতে হয় দূরে। এখানেই প্রাসঙ্গিক হয় বোদরিয়ার্দ এর অতিবাস্তবতা বা হাইপার রিয়েলিটি তত্ত্ব। বানানো পরিচয়-কে, আসল পরিচয় থেকে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হতে থাকে।



ছক কাটা নজরদারি

সবাই সোশ্যাল মিডিয়ায় খাঁটি বা অথেন্টিক হয়ে উঠতে চায়। খুব যত্ন করে, অনেক কিছু চিন্তা করে, নানা টুল ব্যবহার করে নির্মাণ করতে হয় এই খাঁটিত্ব।

আপাত অর্থে আমাদের পার্ফর্ম্যান্সের পরিচালক হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম।

এর কেটে দেয়া ছক বা অ্যালগরিদম ঠিক করে দেয়, কে কার কোন পার্ফর্ম্যান্সটা দেখবে, কিভাবে তাতে প্রতিক্রিয়া জানাবে। মিশেল ফুকো যেমন বলেছিলেন পেনোপ্টিকন মডেলের কথা। সামজিক মাধ্যমে সবাই নজরদার, সবাই নজরবন্দি।

ঠিক এই কারনেই নিজেদের সব সময় শুধরে নিতে হচ্ছে আমাদের। পোস্ট মুছে দিতে হচ্ছে, ছবি এডিট করতে হচ্ছে, কায়দা করে ছবির ক্যাপ্সন লিখতে হচ্ছে। কোনটাই নিজের জন্য নয়! নিজের কি ইচ্ছা সেটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে, কারন সারাক্ষণই ভাবতে হয় এক গাদা লোক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অরা কি ভাবছে, ওরা কিভাবে সমালোচনা করছে!

সবাই সোশ্যাল মিডিয়ায় খাঁটি বা অথেন্টিক হয়ে উঠতে চায়। খুব যত্ন করে, অনেক কিছু চিন্তা করে, নানা টুল ব্যবহার করে নির্মাণ করতে হয় এই খাঁটিত্ব। কি ক্যাজুয়াল ফটো, কি ঘুম থেকে ওঠা ছবি কিংবা ক্যান্ডিড হাসি- কোনটাই ক্যাজুয়াল বা ক্যান্ডিড যে আসলে না, সেটা সবাই জেনে গেছে। খাঁটি নিজেই একটা সামাজিক মুদ্রার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে; বিনিময়মূল্য হচ্ছে, লাইক আর কমেন্ট।

পরিচয় এখন পণ্য, অন্তত সোশ্যাল মিডিয়ায়।

ইনফ্লুয়েন্সাররা এখন মাঠ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন, স্বপ্ন তৈরি করছেন। ফলে প্রতিটা সামাজিক মাধ্যমের সদস্য চায় একদিন তার ফলোয়ার লক্ষ ছাড়াবে, প্রতিটা পোস্টে হাজার হাজার মানুষ আসবে কথা বলতে। মার্শাল ম্যাক্লুহানের সেই যে কথাটা- মাধ্যমই এখন বার্তা (The medium is the message), সেটা এখন হয়ে উঠেছে- ব্যক্তিই এখন বার্তা (the self is the message)।

ব্যক্তির পরিচয় এখন আর ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক নির্মাণ; একে বিনির্মাণ করা যায়, সমালোচনা করা যায়। সধারন যে কোন মানূষ রাতারাতি হয়ে যেতে পারে মিমর চরিত্র। সেই মিমে সে যে কথা বলে যাবে, কোনটাই তার কথা না; কথাগুলো তার সম্পর্কে মানুষ কি ভাবে তার প্রকাশ।



তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে?

ব্যক্তির পরিচয় তাহলে অন্তহীন, ছক কাটা পারফরম্যান্স মাত্র? অত সরল করে বলা যাবে বলে মনে হয় না। সামাজিক মাধ্যম পরিচয় এর সংজ্ঞা পাল্টে দিচ্ছে সত্যি, কিন্তু এটাও তো ঠিক, ব্যক্তিকে দাঁড় করিয়েছে নিজেকে আর গভীরভাবে চেনার পথের সামনে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ছে, কথার আদান প্রদান হচ্ছে, মতের বিনিময় হচ্ছে; তার ফলে ব্যক্তির বিশ্বাসের সীমানা বাড়ছে, জানার পরিধি বাড়ছে। সামাজিক মাধ্যম আমাদের পাল্টে দিচ্ছে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন নয়; প্রশ্ন হল- আমরা কি বুঝতে পারছি এই মাধ্যম কিভাবে পাল্টে দিচ্ছে আমাদের?

পড়ে দেখতে পারেন