জাতীয় সঙ্গীতের দার্শনিক সংকট
ক্রিকেটে বিরোধ কিংবা রাজনীতিতে বিরোধ? মুখ দেখাদেখি বন্ধ?
এক অনুষ্ঠানে সবাইকে হাজির করে চালিয়ে দেয়া হোক জাতীয় সঙ্গীত। ফলাফল?
সবার বুকে হাত, সবাই টানটান দাঁড়িয়ে যাবে।
কন্ঠ মিলিয়ে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন সময়ে সবাই আবেগী নিজের দেশের গৌরব, ইতিহাস আর স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু যে ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত লেখা, তার চেয়ে ভিন্নভাষী কেউ যদি সেখানে থাকে? যে ধর্মের কথা সঙ্গীতে বলা হচ্ছে, তার চেয়ে ভিন্নধর্মের কেউ যদি সেখানে থাকে? সে কি একইভাবে আন্দোলিত হবে?
রাষ্ট্র আছে মানেই তার কিছু প্রতীক লাগবে।
সব নাগরিককে এক সংবিধান, এক পতাকা, এক গান, এক সৌধ, এক লোগো শুধু ব্যবহার করলেই চলবে না; অনুগত থাকতে হবে এই সব সাধারণ প্রতীকের প্রতি। তাই পৃথিবীর সব জাতীয় সঙ্গীতে দৃষ্টিভঙ্গিগুলো মোটামুটি কাছাকাছি থাকে। গানগুলোতে যে বিষয়গুলো উঠে আসে, সেগুলো মোটামুটি এই রকম-
- ক
- খ
- গ
- ঘ
- ঙ
- চ
- ছ
- জ
আমার দেশ মায়ের মত সুন্দর; মায়ের মত স্নেহে সে তার সব সন্তানদের দেখে শুনে রাখছে
আমার দেশ বীরের জাতি; দেশ আমার বীর জাতির জননী
আমার দেশ পবিত্র স্থান
আমার দেশ খোদার আশীর্বাদ
আমার দেশ মুক্ত মানুষের দেশ
আমার দেশকে কখনো বিদেশীদের হাতে শাসিত হতে দেব না; কেউ শাসন করতে আসলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করব
আমার দেশের পতাকা দুলে যাবে আজীবন; আর এর দুলে যাওয়া মানেই স্বাধীনতা, শান্তি
আমার দেশ অতীতকাল থেকে সমৃদ্ধ দেশ, ভবিষ্যতেও এটি হবে সবচেয়ে সেরা দেশ
মুশকিল হল, জাতি রাষ্ট্র যখন গঠিত হয়, তখন তাকে ঐক্যবদ্ধ করতে হয় নানা সংস্কৃতি, নানা ভাষাভাষী, নানা দর্শন, নানা মতের মানুষকে। সর্বোচ্চ আন্তরিকতা থাকার পরেও এত কিছুকে এক করে কি একটা সঙ্গীতকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়? এই প্রশ্নের জবাব একটু ভিন্নভাবে খোঁজা যাক।
জাতীয় সঙ্গীত যতভাবে তার দেশকে উপস্থাপন করে, সেই দর্শন আর তার সংকটের কিছু নজির এই ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
গানে পুণ্যভূমি হিসেবে দেশ
জাতীয় সঙ্গীতে দেশকে ঈশ্বরের মহিমা বা পুণ্যভূমি বলে ঘোষণা দেয়ার ভাবনা এসেছে জাতি রাষ্ট্রের ধারনার শুরুতেই।
জাতীয়তাবাদকে ধর্মের সাথে মিশিয়ে নিজের অস্তিত্বকে একটা পবিত্র চেহারা দেয়াটাই এর প্রধান লক্ষ্য। এই সঙ্গীত জনগণকে আশ্বস্ত করতে চায়- এই রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকে তুমি আসলে খোদাকেই সন্তুষ্ট করছ। পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত যেমন বলছে-
"হে পুণ্য ভূমি আনন্দিত থাক,
হে সুরূপ দেশ আনন্দিত থাক,
তুই মহান সঙ্কল্পের চিহ্ন,
হে পাকিস্তান ভূখণ্ড!
বিশ্বাসের কেন্দ্র আনন্দিত থাক।"
উর্দুতে লেখা এই গান সমালোচিত হয় ভিন্নভাষীদের দ্বারা। সিন্ধ, বালুচ বা পশতুভাষীরা মনে করে তাদের কথা প্রতিফিলিত হয়নি এখানে।
পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের সুর তৈরি হয়েছে ১৯৪৯ সালে কিন্তু কথা তৈরি হয়েছে ১৯৫৪ সালে। দেশটি খুব স্পষ্টভাবে নিজেকে ধর্মীয় রাষ্ট্র বলে। তাই তার এই জাতীয় সঙ্গীতের মানে বোধগম্য।
কিন্তু সুইজারল্যান্ড এর মত গণতান্ত্রিক আর সেক্যুলার দেশের জাতীয় সঙ্গীত শুনে চমকে উঠতেই হয়-
When the morning skies grow red
And o'er their radiance shed,
Thou, O Lord, appeareth in their light.
When the Alps glow bright with splendour,
Pray, free Swiss, Pray,
For you feel and understand,
For you feel and understand,
That he dwelleth in this land.
That he dwelleth in this land.
বাংলা করলে দাঁড়ায়-
যবে ভোরের আকাশ রাঙা হয়,
আলোয় ভেসে উঠে লালিমায়,
হে প্রভু, তুমি জাগো সেই আলোয়।
যবে আল্পস দীপ্তি ছড়ায় দূর,
প্রার্থনা কর, হে মুক্ত সুইস,
কারণ হৃদয়ে তুমি জানো,
কারণ হৃদয়ে তুমি মানো,
এই মাটিতে তাঁর বাস!
এই মাটিতে তাঁর বাস!
এই গানের ব্যাপারে সমালোচনা এসেছে খোদ সুইজারল্যান্ডবাসীদের মধ্য থেকেই। মূল গানটি লেখা হয়েছিল সেই উনবিংশ শতাব্দীতে; জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ১৯৮১ সালে। জটিল শব্দ আর কঠিন সুরের কারণে তরুণদের কাছে এর আবেদন কমে যায়। দাবি উঠে জাতীয় সঙ্গীত পাল্টানোর।
সেই জন্য ২০১৪ সালে সরকার জাতীয় পর্যায়ে একটা প্রতিযোগিতাও আয়োজন করে ফেলে। তার ঘোষিত লক্ষ্যই ছিল- গণতন্ত্র, সৌহার্দ্য আর বৈচিত্র্যের বানী থাকতে হবে নতুন জাতীয় সঙ্গীতে। কিন্তু এরপরও পেরিয়েছে এক যুগ। এখনো সঠিক জাতীয় সঙ্গীত খুঁজে পায়নি দেশটি।
গানে লড়াইয়ের জোস জাগানো দেশ
পোস্ট কলোনিয়াল বুদ্ধিজীবী তারেক মদুদ বা স্টিফেন হেসেল'ও বলছেন- কলোনিয়াল ইতিহাসের চিহ্ন বহন করা এই গান আজকের ফ্রান্সের জাতীয় ঐক্যের জন্য মোটেও সহায়ক নয়।
খোদার কসম কেটে দেশকে ভালবাসতে বলা অনেক দেশের পছন্দ না। এরা সবসময় নিজেদের দেখে দৌড়ের উপর।
দ্রুতলয়ের সুর, উদ্দীপনাময় অর্কেস্ট্রার সাথে গানের কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেয়- দেশের আহ্বান আর সব সময় নিজেদের প্রস্তুত রাখার জরুরত।
সুইজারল্যান্ডের তরুণরা আঠারো শতাব্দীর গানকে সেকেল বলছে কিন্তু ফ্রান্সের 'লা মার্সিয়েস' কম্পোজ করা হয়েছিল কিন্তু ১৭৯২ সালে। ফ্রেঞ্চ বিপ্লবের সময় এক সেনা অফিসার গানটি লিখেছিলেন বিদেশী মনার্কির বিরুদ্ধে ফ্রেঞ্চ রিপাবলিকের পক্ষের যোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য।
গানের কথায় আছে-
Arise, children of the Fatherland,
The day of glory has arrived!
Against us, tyranny's
Bloody standard is raised, (repeat)
Do you hear, in the countryside,
The roar of those ferocious soldiers?
They're coming right into your arms
To cut the throats of your sons, your women!
বাংলা করলে দাঁড়ায়-
জাগো, পিতৃভূমির সন্তানগণ,
গৌরবের দিন এসেছে আজ!
আমাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের
রাঙ্গা নিশান তুলেছে রাজ!
শুনছ কি, ঐ সুদূর প্রান্তরে,
কাঁপছে হিংস্র সেনাদের গর্জনে?
আসছে তারা ছুটে তোমার দিকে
নারীদের, সন্তানদের হত্যা করতে!
এই যে সব ভয়ংকর গা ছমছমে লাইন, যেগুলো লেখাই হয়েছিল যুদ্ধে মাতিয়ে তোলার জন্য- এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন জা পল সাত্রে (Existentialism is a Humanism, 1946), আলবেয়ার কামু The Myth of Sisyphus (1942), ফ্রাঞ্জ ফানো'র (The Wretched of the Earth, 1961) মত বুদ্ধিজীবীরাও। পোস্ট কলোনিয়াল বুদ্ধিজীবী তারেক মদুদ বা স্টিফেন হেসেল'ও বলছেন- কলোনিয়াল ইতিহাসের চিহ্ন বহন করা এই গান আজকের ফ্রান্সের জাতীয় ঐক্যের জন্য মোটেও সহায়ক নয়।
আবার এই গানের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছেন মিশেল অনফ্রে, বার্নার্ড-হেনরি লেভি'র (The French Revolution) মত উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীরা। তাদের মতে অন্যায় আর শোষণের বিরুদ্ধে এই গানে যে শক্তিশালী বাক্য আছে, তা আজকের ফ্রেঞ্চ জনগণের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানকেই তুলে ধরে।
গানে ঐক্যের আহ্বান জানানো দেশ
অ্যালিস শোয়ার্জার'র মত নারীবাদী সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছেন 'পিতৃভূমি' শব্দ নিয়ে- আজকের যুগে কি এই শব্দ ব্যবহার করা কি শোভন?
ফ্রেঞ্চরা তো তাও একটা গানের পক্ষে বিপক্ষে আছে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে জার্মান জাতীয় সঙ্গীতকে। সে তার 'জোস জাগানো' ভূমিকা পাল্টে হয়ে উঠেছে জাতির প্রেরণার গান।
জার্মানির এখন যে জাতীয় সঙ্গীত, তার সুর নেয়া হয়েছে ১৭৯৭ তে জোসেফ হেয়ডেন এর একটি কম্পোজিশন থেকে। আর লিরিক লেখা হয় ১৮১৪ সালে কবি হফম্যানের হাতে। বিচ্ছিন্ন বেশ কিছু রাজ্যকে একত্র করে বৃহত্তর জার্মান পরিচয় তুলে ধরাই ছিল গানের উদ্দেশ্য। তবে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে এর স্বীকৃতি মিলে ১৮৭১ সালে, ফ্রাঙ্কো প্রাশিয়ান যুদ্ধের পরে। জার্মান সম্রাটের পতনের পরে যখন ওয়েইমার রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন গানের কথায় পরিবর্তন আসে।
সেই সময় গানের কথা ছিল-
Germany, Germany above all,
Above all in the world,
When it always stands united,
Brotherly, for protection and defense.
From the Meuse to the Memel,
From the Adige to the Belt –
Germany, Germany above all,
Above all in the world!
জার্মানি, জার্মানি সবার ওপরে,
থাকে পৃথিবীর সব কিছুর ওপরে,
যখন থাকে সে ঐক্যবদ্ধ,
ভাইয়ের মত, প্রতিরক্ষায়।
মেইজ থেকে মেমেল
এডিজ থেকে বেল্ট
জার্মানি, জার্মানি সবার ওপরে,
থাকে পৃথিবীর সব কিছুর ওপরে!
নাজি শাসনের সময় গানটির প্রথম স্তবকটি শুধু জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পায়।
জার্মানি, জার্মানি সবার ওপরে,
থাকে পৃথিবীর সব কিছুর ওপর
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গানটির শুধু তৃতীয় স্তবকটাকেই বেছে নেয়া হয় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে। এখানে দেশের মুলনীতিগুলো বারবার করে স্মরণ করিয়ে দিয়ে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা বলা হচ্ছে।
Unity and justice and freedom
For the German fatherland!
Let us all strive for this purpose
Brotherly with heart and hand!
Unity and justice and freedom
Are the guarantee of happiness;
Flourish in the glory of this happiness,
Flourish, German fatherland!
বাংলা করলে দাঁড়ায়-
ঐক্য আর ন্যায় আর মুক্তি
জার্মান পিতৃভূমির জন্য!
চল সবাই এগুই সেই লক্ষ্যে
এক মনে হাতে হাত রেখে!
ঐক্য আর ন্যায় আর মুক্তি
তাতেই পাওয়া যাবে সুখ;
আনন্দে গৌরবে বিকশিত
বিকশিত হও জার্মান পিতৃভূমি!
এই গান নিয়েও সমালোচনার কমতি নেই। সমালোচনার প্রথম পয়েন্টটিই হল- গানের কি অভাব পড়েছে? সেই নাজিদের ব্যবহার করা আদ্যিকালের গান থেকেই কেন জাতীয় সঙ্গীতের লাইন বেছে নিতে হবে! এই সমালোচনা ইয়ুরগেন হাবারমাসের মত দার্শনিকের (The German Question and the Reunification of Germany, 1990)।
অ্যালিস শোয়ার্জার'র মত নারীবাদী সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছেন 'পিতৃভূমি' শব্দ নিয়ে- আজকের যুগে কি এই শব্দ ব্যবহার করা কি শোভন?
নতুন জাতীয় সঙ্গীতের দাবি তুলেছেন রাইনা মারিয়া রিলক'র মত বড় কবিও।
এই গানের তলায় যে এখনো যুদ্ধ যুদ্ধ ব্যাপারটা আছে, তার সমালোচনা করেছেন সাবেক পূর্ব জার্মানির গায়ক ও বামপন্থী কর্মী ওলফ বিয়েরম্যান (Wolf Biermann: A Political Poet, 1994)।
জার্মানিদের সাথে ইজিপ্টের জাতীয় সঙ্গীতের মিল দুটো জায়গায়। এক, ঐক্যের আহ্বান রয়েছে দুটো গানেই আর দুই, তিনবার পরিবর্তন করে অবশেষে বর্তমান সংস্করণে থিতু হয়েছে গানটি।
১৯৫৮ সালে গামাল আব্দুল নাসের এর শাওনামলে যে জাতীয় সঙ্গীতটি প্রচলিত ছিল, তার মেজাজ ছিল 'জোস জাগানিয়া', যুদ্ধংদেহী- Walla Zaman Ya Selahy বা "বহুদিন দেখা হয়নি, প্রিয় হাতিয়ার আমার"। তারও আগে, ১৯২৩ থেকে ১৯৫৮ তে রাজতন্ত্রের সময়কালে ছিল Salam Affandina বা "প্রভুকে সালাম"।
এরপর ১৯৭৯ সালে যে গানটি জাতীয় সঙ্গীত হল, তার লিরিক লিখা হয়েছে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক'র একটি ভাষণ অবলম্বনে। সুর নেয়া হয়েছে সায়েদ দারভিশ'র কম্পোজ করা পিস থেকে। গানের তৃতীয় স্তবকে বলা হচ্ছে-
Egypt! Noble are thy children,
Loyal, and guardians of the reins.
It will attain high aspirations
With their unity and with mine.
অর্থাৎ-
ইজিপ্ট, তোমার সন্তানরা মহৎ,
তোমার অনুগত, এবং তোমার প্রহরী।
হোক যুদ্ধে, থাকুক শান্তি
সবাই আত্মত্যাগে প্রস্তুত, আমার স্বদেশ।
সবাইকে এক ইজিপ্টের জন্য আত্মত্যাগের আহ্বান জানিয়েছে ইজিপ্টের জাতীয় সঙ্গীত। এবং বিষয়টাকে বেশ সিরিয়াসলি নিয়েছে তারা। ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট আদলি মনসুর একটা আইন জারি করেন। সেখানে বলা আছে- জাতীয় সঙ্গীতের কোন রকম অবমাননা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে; শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড আর প্রায় সাড়ে চার হাজার ডলার ফাইন!
আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়াও তার জাতীয় সঙ্গীতে বলছে-
For The Gambia, our homeland
We strive and work and pray,
That all may live in unity,
Freedom and peace each day.
অর্থাৎ-
গাম্বিয়া, প্রিয় স্বদেশের জন্য
আমরা এগিয়ে চলি, কাজ করি আর প্রার্থনায় বসি,
যাতে সবাই থাকতে পারি এক,
প্রতিদিনের মুক্তি আর শান্তিতে।
গানে গর্বের প্রতীক হিসেবে দেশ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই তারা বুঝতে পারে, দেশপ্রেমে 'উস্কানি' দেয়ার জন্য একটা জাতীয় সঙ্গীত লাগবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতের নাম The Star-Spangled Banner। ১৮১২ সালে বৃটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পরে একজন আইনজীবী আর শখের কবি ফ্রান্সিস স্কট কি- একটা গান লিখেন। মার্কিন দুর্গ দখলের জন্য বৃটিশদের উপর্যুপুরি বোমা হামলার পরেও আমেরিকান পতাকা মাথা তুলে ছিল ভোরের আকাশে- এই দৃশ্যটি ছিল লিরিকের অনুপ্রেরণা। আমেরিকান জনগণ মাথা নত করতে জানে না- এই হচ্ছে গানের মূল বিষয়বস্তু। গানের কথায় আছে-
O say can you see, by the dawn's early light,
What so proudly we hailed at the twilight's last gleaming,
Whose broad stripes and bright stars through the perilous fight,
O'er the ramparts we watched, were so gallantly streaming?
And the rocket's red glare, the bombs bursting in air,
Gave proof through the night that our flag was still there;
O say does that star-spangled banner yet wave
O'er the land of the free and the home of the brave?
বাংলায়-
বল, তুমি দেখতে পাচ্ছ না, ভোরের নতুন আলোয়,
গত সন্ধ্যার ম্লান আলোয় যাকে গর্বভরে জানিয়েছিলাম অভিবাদন,
ভয়ংকর যুদ্ধের মধ্যেও চওড়া রেখা আর উজ্জ্বল তারারা,
ঐ প্রাচীরের ওপরে জ্বলজ্বল করে উড়ছে?
রকেটের লাল ঝলকানি, শূণ্যে বোমার বিস্ফোরণ,
সারা রাত দিয়েছে প্রমাণ আমাদের পতাকার অস্তিত্বের;
বল, দেখতে পাচ্ছ না, তারা শোভিত পতাকা এখনো দুলছে
এই স্বাধীন আর বীরের ভূমির ওপর?
গানটি জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পায় ১৯৩১ সালে। এত দেরি হওয়ার কারণ সম্ভবত, কোন জাতীয় সঙ্গীতের তেমন প্রয়োজন পড়েনি কখনো তাদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই তারা বুঝতে পারে, দেশপ্রেমে উস্কানি দেয়ার জন্য একটা জাতীয় সঙ্গীত লাগবে। ততদিনে ঐ The Star-Spangled Banner কিন্তু গাওয়া শুরু হয়েছিল সামরিক অনুষ্ঠানে। আর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল যুদ্ধ ফেরত সেনা সদস্যরা।
এই জাতীয় সঙ্গীত নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। ফ্রান্সিস স্কট কি ছিলেন একজন দাস মালিক আর ভয়াবহ বর্ণবাদী ভাবনার সমর্থক। তাই তার লেখা গ্রহণ করা যায় না- এই ছিল প্রধান সমালোচনা।
কেউ বলছেন, জাতীয় সঙ্গীতটি যে কবিতার অংশ, সেখানেই একটি স্তবকে আছে- "No refuge could save the hireling and slave,/ From the terror of flight, or the gloom of the grave."
এই দাস কি সেই দাস, যাদের বৃটিশরা মুক্তি দেয়ার লোভ দেখিয়ে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করিয়েছিল? না কি বৃটিশ আর তার আমেরিকান সহযোগী, সবাইকেই কবি দাস বলেছেন- এই নিয়ে আছে বিতর্ক।
বীরের জাতি হিসেবে প্রচার করা দেশ
বীরত্বের প্রচার ছাড়া তার নাগরিকদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ নেয়ানো কঠিন হয়ে যায়।
সব জাতিই হয়ত নিজেকে বীরের জাতি হিসেবে দেখে।
এই বীরত্বের প্রচার ছাড়া তার নাগরিকদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ নেয়ানো কঠিন হয়ে যায়। এই রকম লিরিক যাদের আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হল- আর্জেন্টিনা।
স্পেইনের কলোনিয়াল শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরে ১৮১৩ সালে নিজেদের জাতীয় সঙ্গীত বেছে নেয় আর্জেন্টিনা। স্বাধীনতা যোদ্ধা এবং রাজনীতিবিদ ভিন্সেন্ট লোপেইজ প্লেইন্স লিখেন এই গানের লিরিক। স্বাভাবিকভাবে এই গানের ছত্রে ছত্রে ছিল স্পেইন বিরোধী কথাবার্তা। কিন্তু পরে যখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রয়োজনে স্পেইনের সাথে সম্পর্ক কাছাকাছি আসে, তখন সংশোধন করা হয় লিরিক। ১৯২৪ সালে গানের যে চেহারা দাঁড়ায়, তা হল-
Hear, mortals, the sacred cry:
"Freedom! Freedom! Freedom!"
Hear the noise of broken chains,
see the noble Equality enthroned.
On the surface of this land now rises
A Nation glorious and new,
Her head is crowned with laurels,
And a Lion lies at her feet.
বাংলায়-
শোন শোন মানুষ সেই পবিত্র আহ্বানঃ
মুক্তি! মুক্তি! মুক্তি!
শোন শোন শেকল ভাঙ্গার গান,
দেখ মহৎ সাম্যের জয়।
এই দেশে দেখ জেগে উঠছে
এক গর্বিত আর নতুন জাতি,
তার মাথায় অর্জনের মুকুট,
সিংহ বসে তার পায়ের কাছে।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তুরস্ক একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ের পরে দেশের সার্বভৌমত্ব মজবুত করতে জাতীয় প্রতীক দরকার হয়ে পড়ে। ১৯২১ সালে আহ্বান করা এক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয় জাতীয় সঙ্গীতের কথা আর সুর। সদ্য স্বাধীন দেশের বিজয়ীদের বীরত্বের কথাই প্রাধান্য পেয়েছে এখানে স্বাভাবিকভাবেই-
Oh coy crescent do not frown for I am ready to sacrifice myself for you!
Please smile upon my heroic nation, why that anger, why that rage?
If you frown, our blood shed for you will not be worthy.
Freedom is the right of my nation who worships God and seeks what is right.
বাংলায়-
হে লাল পতাকা, ভাবনা কেন, আমরা প্রস্তুত কোরবানি হতে!
বীর জাতির দিকে চেয়ে হাস তুমি, কেন মলিন বদন?
তুমি বিষণ্ণ হলে আমাদের রক্তদান বৃথা হয়ে যাবে।
খোদাভক্ত ন্যাপরায়ন আমার জাতির আছে মুক্তির অধিকার।
সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে দেশ
দেশের সৌন্দর্যের প্রতীকের আরেক অনন্য উদাহরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
কিছু জাতীয় সঙ্গীত আছে, জোর দেয় মূলত দেশের রূপের ওপর। এর এক বড় উদাহরণ শ্রীলংকা। বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরে ১৯৫১ সালে স্বীকৃত এই জাতীয় সঙ্গীতের কথাগুলো এই রকম-
Thou Mother Lanka,
Oh Mother Lanka we salute, salute, salute, salute Thee!
Plenteous in prosperity, Thou,
Beauteous in grace and love,
Laden with grain and luscious fruit,
And fragrant flowers of radiant hue,
Giver of life and all good things,
Our land of joy and victory,
Receive our grateful praise sublime, we worship, worship Thee.
Oh Mother Lanka! We salute, salute, salute, salute Thee!
বাংলায়-
ও মা লংকা
ও মা লংকা তোমায় প্রণাম প্রণাম প্রণাম!
কি বিপুল ঐশ্চর্য্য তোমার
শস্যে ফলে ভরা তোমার গোলা,
বর্ণিল ফুলের গন্ধে ভরা,
জীবনদায়িনী তুমি মঙ্গলময়,
এই ভূমি আনন্দ আর বিজয়ের,
আমাদের কৃতজ্ঞ গভীর ভালবাসা জেনও, তোমায় পুজি আমরা সবাই।
ও মা লংকা! তোমায় প্রণাম প্রণাম প্রণাম!
গানের সবই তো ভাল, কিন্তু এটা গাওয়া হয় সিংহলি ভাষায়। ফলে তামিলরা কখনো একে ভালভাবে নেয়নি। যদিও এই গানের একতা তামিল সংস্করণও চালু হয়েছে, সেটা তেমন গুরুত্ব পায়নি। আবার গানের মধ্যে বুদ্ধ ধর্মের প্রভাবেরও সমালোচনা করেছেন কেউ কেউ। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ থাকার পরে আরও গ্রহণযোগ্য জাতীয় সঙ্গীতের প্রয়োজনীয়তার আলাপ উঠেছে বেশ কয়েকবার, কিন্তু কোন সুরাহা হয়নি।
দেশের সৌন্দর্যের প্রতীকের আরেক অনন্য উদাহরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
মা হিসেবে সম্বোধন করে দেশের প্রতি এমন আকুল নিবেদন আসলেই বেশ বিরল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানটি লিখেছিলেন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। এটি প্রথম গাওয়া হয়েছিল ঐ সালের ২৫ আগস্ট কলকাতা টাউন হলের প্রতিবাদ সভায় (রবি জীবনী, ৫ম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল)। পরে, পাকিস্তান আমলে আগ্রাসী মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিপরীতে যখন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছিল, তখন এই গানটি হয়ে উঠেছিল ভিন্নভাবে প্রতিবাদের প্রতীক।
স্বাধীন বাংলাদেশে এই গানকে বহুবার বিতর্কের মধ্যে পড়তে হয়েছে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবকে হত্যার পরে ক্ষমতায় বসা খোন্দকার মোশতাক আহমদ কমিটি গঠন করে কাজী নজরুল ইসলামের 'নতুনের গান' বা ফররুখ আহমদ'র 'পাঞ্জেরি'কে জাতীয় সঙ্গীত করার উদ্যোগ নিয়েছিল (যুগান্তর, ৭ আগস্ট ২০১৯)। ১৯৭৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান বলেন, রবীন্দ্রনাথ অ-বাংলাদেশী; তাই তার লেখা গান জাতীয় সঙ্গীত হতে পারে না। ২০০২ সালে জামাতের দুই মন্ত্রী ইসলামী চেতনার আলোকে জাতীয় সঙ্গীত সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হন। ২০২৪ সালে জামাতের প্রাক্তন আমির গোলাম আজম'র ছেলে আব্দুল্লাহ হিল আমান আজমী আবার প্রসঙ্গতই তোলেন। তার মতে- ভারত কতৃক প্রণীত এই গান জাতীয় সঙ্গীত হতে পারে না।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা না থাকা, জাতীয় সঙ্গীতের আরেকটি সমালোচনা হতে পারে। যে বিষয়টি খুব সুন্দর সামলেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
ইনক্লুসিভ সঙ্গীতের দেশ
১৯৯৪ সালে বর্ণবাদী শাসন অবসানের পরে গণতন্ত্রের যাত্রায় নেলসন ম্যান্ডেলা চেয়েছেন নতুন করে জাতীয় পরিচয় নির্মাণ করতে।
সারা পৃথিবীর সব দেশের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সঙ্গীত একেবারেই আলাদা- ইনক্লুসিভিটির অনন্য উদাহরণ। এই সঙ্গীত একসাথে পাঁচটি ভাষায় লেখা- জোশা, জুলু, সেসোথো, আফ্রিকানস আর ইংরেজি। দুটো গান এক করে তৈরি হইছে এই গান- এক, 'নিকো সি সি'কেলে আফ্রিকা' আর দুই, 'ডিয়ে স্টেম ভান সুইড-আফ্রিকা'। জোশা আর জুলু ভাষায় গানের প্রথম স্তবক হচ্ছে-
Lord bless Africa,
Let the African sky rise up,
Hear our prayers,
Lord bless us.
সেসোথো ভাষায় গানের দ্বিতীয় স্তবক হচ্ছে-
Lord, bless our people,
End the wars and hardships,
Protect us, Protect the people of our land,
The people of South Africa.
তৃতীয় স্তবক, আফ্রিকান ভাষায়-
From the blue of our heaven,
From the depths of our sea,
Over our eternal mountains,
Where the cliffs echo.
চতুর্থ স্তবক ইংরেজিতে-
Sounds the call to come together,
And united we shall stand,
Let us live and strive for freedom
In South Africa, our land!
১৯৯৪ সালে বর্ণবাদী শাসন অবসানের পরে গণতন্ত্রের যাত্রায় নেলসন ম্যান্ডেলা চেয়েছেন নতুন করে জাতীয় পরিচয় নির্মাণ করতে। তারই ফলাফল এই অভিনব জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু এত কিছু করেও সমালোচনার হাত থেকে রেহাই মেলেনি। দেশটিতে ভাষা আছে ১১ টি। তাহলে কেন মাত্র পাঁচটি নির্বাচন করা হল!
পৃথিবীতে কেবল একটি দেশই আছে, যার জাতীয় সঙ্গীতে কোন কথা নেই। গানের নাম 'মার্চা রিয়েল'; কম্পোজ করা হয়েছে ১৮০০ শতাব্দীর কোন এক সময়ে। আর এটি জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পায় ১৮৩৩ সালের পরে, ইসাবেলার শাসনের সময়।
কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতে এই কথা না থাকার ব্যাপারটা সব সময়ই অস্বস্তিতে রেখেছে স্পেনিয়ার্ডদের। এই নিয়ে এত তর্ক বিতর্ক হয়েছে যে, ২০০৭ সালে স্পেন সরকার লিরিকের জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতারা ঘোষণা দেয়। কিন্তু তবু রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত কোন লিরিকের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কথা ছিল, জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক হবে জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু হতে পারছে কই!
প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, জাতীয় সঙ্গীত আসলে একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাবনাকেই ধারণ করে। তাদের গর্ব, ঐতিহ্য, শৌর্য আর স্বপ্নের গল্প শোনায়। এই প্রতীক যদি তার উপযোগিতার প্রমাণই রাখতে না পারে, তাহলে এর টিকে থাকার প্রয়োজন কি আর থাকে? জবাব খুঁজবে ভবিষ্যৎ জাতিরাষ্ট্র।


