আজকের এসপিওনাজ: জেমস বন্ড আর প্রাসঙ্গিক না!

ইয়ান ফ্লেমিংয়ের জেমস বন্ড এসপিওনাজের যে রোমান্টিক চিত্র এঁকে রেখেছে, সেটা মুছে ফেলা বড্ড মুশকিল! পৃথিবীর যেখানেই মন্দ লোক, ভয়ংকর ষড়যন্ত্র- সেখানেই অসম্ভব মিশন নিয়ে হাজির জেমস বন্ড। সাধারণ মানুষের পক্ষে যেখানে জাল ছেড়ে দেয়া স্বাভাবিক, সেখানে দুষ্টের দমন করে নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরে প্রেম করতে শুরু করে বন্ড। চুমুক দেয় মার্টিনিতে- শেইকেন নট স্টিয়ার্ড।
হলিউডে, ইউরোপে বা রাশিয়ায় জেমস বন্ড প্রভাবিত কয় হাজার মুভি হয়েছে - গুনে শেষ করা মুশকিল। এর প্রভাবে এখনো ইম্পসিবল মিশন নিয়ে ছুটছে বুড়ো ইথান ওরফে টম ক্রুজ; ছুটছে এমনকি জনি ইংলিশ পর্যন্ত!
কিন্তু শীতল যুদ্ধের পরে এসপিওনাজ এখন আর ঠিক সেই চেহারায় নেই। ফিল্মে যাই দেখানো হোক না কেন, ব্যক্তিগত হিরোইজমের গল্প এখন বলতে গেলে প্রায় অতীত।
এসপিওনাজের ঐতিহ্য বনাম বর্তমান বাস্তবতা

ঠান্ডা যুদ্ধের সময় গুপ্তচরবৃত্তির যে চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, সেখানে স্পষ্ট শত্রু-মিত্র ভাগ ছিল।
লড়াইটা একসময় ছিল সোজাসাপ্টা; পুঁজিবাদী বনাম সমাজতান্ত্রিক দেশ।
আরও স্পষ্ট করে বললে আমেরিকান ব্লক আর সোভিয়েত ব্লকের মধ্যে যা কিছু ঝামেলা, তা-ই ছড়িয়ে পড়ত গোটা পৃথিবীতে।
সেই ঠান্ডা যুদ্ধের সময় এসপিওনাজ বা গুপ্তচরবৃত্তির চেহারা ছিল অনেকটা সিনেমার মতই। স্পাইয়ের শত্রু আর মিত্র খুব পরিষ্কারভাবে আলাদা করা যেত।
হয় সে আমেরিকা বা তার মিত্রদের হয়ে কমিউনিস্ট ভিলেনদের ঘায়েল করছে; নয়ত কমিউনিস্ট ব্লকের রক্ষায় হানা দিচ্ছে পুঁজিবাদের দুর্গে। সে নিঃসঙ্গ, বেপরোয়া, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা ধরতে প্রস্তুত অকুতোভয়, প্রায় সুপারহিরো। তাদের ক্ষিপ্রতা ছিল বিস্ময়কর, বুদ্ধি ছুরির চেয়েও ধারালো; সাথে থাকত ভয়ংকর জিনিয়াস কোন বিজ্ঞানীর উদ্ভাবন করা আজগুবি সব গেজেট- কখনো সেটা গাড়ি, কখনো সেটা ঘড়ি।
কিন্তু এখনকার বাস্তবতা বদলেছে। আজকের এসপিওনাজ অতটা সোজা নয় (বাইনারি নয়!)।
আমেরিকার সাথে চীনের সমস্যা, চীনের সাথে ভারতের সমস্যা, আমেরিকার সাথে ভারতের মিশ্র সম্পর্ক; ওদিকে আবার রাশিয়ার সাথে ইউরোপের সমস্যা, ইউরোপের নিজেদের মধ্যে সমস্যা- সব মিলে বানিজ্যযুদ্ধ এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চরিত্র ঠিক করে দেয়।
ফলে পুরো পৃথিবী এখন সারভেইলন্সের অধীন। প্রতিটি ইঞ্চির দিকে চোখ রাখা যায় এখানে। তথ্য হয়ে উঠেছে আরেক ধরণের মারণাস্ত্র। প্রযুক্তি খুলে দিয়েছে এক নতুন সময়ের দরজা। এই সময়ে স্পাইরাও আর একই রকম করে কাজ করতে পারে বা। আজকের গুপ্তচরের জন্য শুধু শারীরিক সাহস নয়, তথ্য বিশ্লেষণ আর প্রযুক্তি বোঝার ক্ষমতাও জরুরি। গোয়েন্দা জগৎ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি জটিল, প্রযুক্তিনির্ভর এবং বহুস্তরীয়।
স্পাইং এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মূলত তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করা। সাইবার হামলার ব্যাপারে তটস্থ থাকা। এখন শত্রু শুধু কোনো একটা দেশ না; শত্রু হতে পারে সাইবার সংগঠন, তথ্য চুরির নেটওয়ার্ক। আগের মতো এক সাহসী স্পাই এসে এখন এত কিছু সামলাতে পারবে না। গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাতে লাগে বিশাল বিশ্লেষক দল। একযোগে কাজ করতে হয় প্রযুক্তিবিদ, সাইবার বিশেষজ্ঞ আর তথ্য বিজ্ঞানীদের।
সাইবার স্পাইং এর উত্থান

এখন রাষ্ট্র এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই ডিজিটাল অনুপ্রবেশ ঠেকানো।
গুপ্তচরবৃত্তির সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে সাইবার প্রযুক্তির উত্থানে। ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে এখন সাইবার স্পেস এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এখন সাইবার গোয়েন্দাগিরিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে, যেখানে শক্তিশালী প্রযুক্তি ব্যবহার করে শত্রুপক্ষের নেটওয়ার্ক হ্যাক করা, গোপন তথ্য চুরি করা, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে নাশকতা চালানোর মতো কাজ হচ্ছে। ফলে প্রচলিত মানব গোয়েন্দাগিরির (HUMINT) তুলনায় ডিজিটাল পদ্ধতির গুরুত্ব বেড়ে গেছে।
সাইবার গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে দূর থেকে গোপন তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব, যা ভূগোলের সীমানা মুছে দিয়েছে। এখন রাষ্ট্র এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই ডিজিটাল অনুপ্রবেশ ঠেকানো। কিন্তু সমস্যাটা হলো, অনেক ক্ষেত্রেই এই সাইবার আক্রমণের উৎস খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
তথ্য আর তথ্য

সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স (SIGINT) ও ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স (OSINT) এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বর্তমানে গোয়েন্দাগিরির মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছে তথ্য বা ডেটা সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ।
এখন স্যাটেলাইট চিত্র, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইলেকট্রনিক যোগাযোগ থেকে বিপুল তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং এসব বিশ্লেষণ করাই গোয়েন্দাগিরির অন্যতম চাবিকাঠি। সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স (SIGINT) ও ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স (OSINT) এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বিশাল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করতে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, যা তথ্যের মধ্যে গোপন নিদর্শন বা প্রবণতা চিহ্নিত করতে পারে। এতে ব্যক্তিগত এজেন্টের ভূমিকা কমে গিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন বিশ্লেষক ও তথ্য বিজ্ঞানীদের দল গড়ে তুলছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাষ্ট্রবিহীন শত্রু

বর্তমানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র এবং সাইবার অপরাধীরা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গুপ্তচরবৃত্তির জগতে আরেকটি বড় পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন এসেছে রাষ্ট্রবিহীন শক্তির উত্থানের কারণে।
বর্তমানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র এবং সাইবার অপরাধীরা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা কোনো নির্দিষ্ট দেশের প্রতিনিধিত্ব করে না। এরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গোপনে কাজ করে।
এই গোষ্ঠীগুলোকে দমন করা খুব কঠিন। কারণ, প্রচলিত সামরিক শক্তি দিয়ে এদের মোকাবিলা করা যায় না। যুদ্ধের ময়দান নেই, নেই পরিষ্কার ফ্রন্ট লাইন।
ফলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তাদের কৌশল বদলাতে হচ্ছে। এখন শুধু সামরিক শত্রুর উপর নজর দিলেই চলবে না। নতুন হুমকির ধরন বুঝে গোয়েন্দা কার্যক্রম সাজাতে হচ্ছে।
শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকলেই আর চলবে না। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞানেরও প্রয়োজন হচ্ছে। কারণ, এই নতুন ধরনের শত্রুদের ধরতে এবং ঠেকাতে মানুষের মনোজগত, সমাজের গঠন আর সংস্কৃতির গভীর বোঝাপড়া দরকার।
নজরদারি বনাম নৈতিকতার টানাপোড়েন

রাষ্ট্র কতটা নজরদারি করতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
বর্তমান যুগে গুপ্তচরবৃত্তির অন্যতম আলোচিত দিক হলো নজরদারির প্রসার।
এখন বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা ব্যক্তিগত যোগাযোগ, অনলাইন কার্যকলাপ, এবং চলাফেরার ওপর নজরদারি করতে সক্ষম। তবে এই সক্ষমতাই এক বিরাট নৈতিক ও আইনগত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
কোনো রাষ্ট্র কতটা নজরদারি করতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার দাবি রয়েছে, কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে এই গোপনীয়তা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই আধুনিক গোয়েন্দাগিরিতে আইন ও নৈতিকতার মধ্যে ভারসাম্য রাখা এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তথ্যযুদ্ধ

বর্তমান যুগে তথ্য ও মতাদর্শিক যুদ্ধও (information warfare) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য সংগ্রহ এখন গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে তথ্য রক্ষা। শত্রু দেশ নানাভাবে দেশের তথ্য চুরির চেষ্টা চালাবে, আর স্পাইদের কাজ হবে সেটা ঠেকানো! এজন্য বিভিন্ন দেশ এখন কৌশলগতভাবে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রক্ষা করার জন্য শক্তিশালী কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স (প্রতিবিশেষণমূলক গোয়েন্দাগিরি) ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
জেমস বন্ডদের দেশের প্রয়োজনে খুন করার লাইসেন্স ছিল। বসরা হুকুম দিলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ত সন্ত্রাসীদের ডেরায়। সেখানে গিয়ে তাকে কোন রাজনীতি বা দর্শনের আলাপ করতে হত না। খুন করে আসাটাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন।
তাছাড়া, বর্তমান যুগে তথ্য ও মতাদর্শিক যুদ্ধও (information warfare) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে অন্য দেশকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করা এক নতুন ধরনের যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। অনেক রাষ্ট্র এখন তথ্য যুদ্ধ চালানোর জন্য বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছে। ফলে আধুনিক গুপ্তচরবৃত্তি কেবল শারীরিক বা ডিজিটাল চোরাগোপ্তা অভিযান নয়, বরং মতাদর্শ ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেরও অংশ হয়ে উঠেছে।
গুপ্তচরবৃত্তি এখন আর আগের মতো কোনো একক নায়ক এজেন্টের দুঃসাহসী অভিযানের গল্প নয়। এটি এখন প্রযুক্তিনির্ভর, দলভিত্তিক এবং বৈশ্বিক সহযোগিতাপূর্ণ একটি ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে। সাইবার গুপ্তচরবৃত্তি, তথ্য বিশ্লেষণ, অরাষ্ট্রীয় শক্তির মোকাবিলা, নজরদারি বনাম গোপনীয়তা, এবং তথ্যযুদ্ধ—এই সবকিছু মিলে বর্তমান গোয়েন্দা কার্যক্রমের নতুন রূপরেখা তৈরি করেছে।
জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো, এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করা। আধুনিক গুপ্তচরবৃত্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই ভারসাম্য বজায় রাখার সক্ষমতার ওপর।