দুনিয়ার বাজারে নতুন ভাগ বাটোয়ারার হিসেব
আরও ছয় বছর আগেই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, আমরা পৃথিবীর পুলিশ না। দেশে দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে রাখা আর চলবে না, কোন জাতি গঠন করে দেয়ার দায়িত্বও আর আমেরিকা নিবে না। সে কেবল তাকাবে নিজের দিকে- 'আমেরিকা ফার্স্ট'। নতুন নীতিতে মুশকিলে পড়ে যাচ্ছে যুদ্ধবাজ সংস্থা ন্যাটো আর সাম্রাজ্যবাদের সংস্থা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন।
তাহলে কি আপাদমস্তক পাল্টে যাচ্ছে আমেরিকা? অবসান হতে যাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের?
এত সহজ হয়ত নয় ব্যাপারটা।
আমেরিকার এই পদক্ষেপটা বুঝতে হলে আজকের যুগের নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাটার দিকে আরেকবার তাকানো দরকার ভাল করে।
তিন++ পক্ষ
১৯৯১ থেকে ২০০৮- এই ১৭ বছরকে ধরা হয় আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের শীর্ষ সময়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপীয়ানদের তুলনায় নানা কারণে এগিয়ে গিয়েছিল মার্কিনীরা।
কমিউনিস্টদের ঠেকানোর নামে সারা দুনিয়ায় গেড়ে বসে ছিল ঘাঁটি। ১৯৯০ তে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে দুনিয়ার প্রায় একচ্ছত্র অধিপতি হয়েছিল আমেরিকা। নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছিল গোটা পৃথিবীর অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে আর সামরিক সিদ্ধান্তে। কি ইরান, কি ইরাক, কি ইউরোপ, কি এশিয়া- সব জায়গায় ছড়ি ঘুরিয়েছে সে প্রায় বিনা চ্যালেঞ্জে। ১৯৯১ থেকে ২০০৮- এই ১৭ বছরকে ধরা হয় আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের শীর্ষ সময়।
তারপরে এল ২০০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দা। ভেঙ্গে পড়ল আমেরিকার আবাসন আর ব্যাংকিং সেক্টর। কমে গেল জিডিপি, বাড়ল বেকারত্ব, ধ্বসে গেল মধ্যবিত্ত, ছড়িয়ে পড়ল বিক্ষোভ আর আন্দোলন।
চকচকে মার্কিন পুঁজিবাদী অর্থনীতির ব্যাপারে স্বপ্নভঙ্গ হতে শুরু করল বিশ্বব্যপী। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল চীন, গড়ে উঠল ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশা, ইন্ডিয়া, চীন আর দক্ষিণ আফ্রিকার জোট), রণে ভঙ্গ দিল সে আফগানিস্তান আর ইরাকে।
এই শূন্যতার মধ্যে উত্থান ডোনাল্ড ট্রাম্প'র। সে এসে আওয়াজ তুলল রাজনীতিবিদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে, ছড়াল জাতীয়তার মন্ত্র, কথা দিল পুনর্গঠন করবে দেশের অর্থনীতি।
আমেরিকা দুনিয়ার দেশ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অর্থনৈতিক কতৃত্ব বজায় রাখার লড়াই থেকে সরে আসেনি।
এখন বিশ্ব বাজারে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মূলত তিনটি পক্ষ; এরা হল-
- ১। চীন
- ২। রাশিয়া
- ৩। ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন
চীনঃ আগামীর কেন্দ্র?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অর্থনীতি খানিকটা হোঁচট খেয়েছে। এটা সে নিজেও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তাই সনাতনী পথে না হেঁটে চীন বিনিয়োগ বাড়িয়েছে নতুন আর বিকল্প সব শিল্প খাতে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, বিশ্বজুড়ে তার প্রভাব জাল ছড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। মোটা দাগে, চীন বিশ্ব বাজারে তার কতৃত্ব গড়ে তুলতে চার ধরণের কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে-
দক্ষিণের জানলা
সবাই পূর্ব-পশ্চিম নিয়ে ব্যস্ত; এই ফাঁকে চীন এগিয়েছে দক্ষিণের দিকে। বিশেষ মনযোগ- আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা।
এখানকার দেশগুলোতে নিজের অবস্থান মজবুত করতে নানান কৌশল বের করে নিয়েছে সে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর মাধ্যমে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে চীন বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করছে রেলপথ, সড়ক, বন্দর এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পে । আফ্রিকায় মোম্বাসা-নাইরোবি স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলওয়ে (SGR) এবং ইথিওপিয়া-জিবুতি রেললাইন এর উদাহরণ।
ল্যাটিন আমেরিকায় পানামা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় বড় বড় বন্দর ও রেল প্রকল্পেও চীন বিনিয়োগ করেছে।
তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে দিয়ে চীন নিজের জায়গা করে নিয়েছে ঐ দেশগুলোর জ্বালানি খাতে।
আফ্রিকার কঙ্গো ও জাম্বিয়ার খনি থেকে সে তুলছে কোবাল্ট আর তামা; বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যাটারি তৈরির অন্যতম উপাদান। আর ল্যাটিন আমেরিকায় ব্রাজিল, চিলি ও আর্জেন্টিনায় লিথিয়াম, তেল ও লোহার খনিতে বিনিয়োগ করছে ব্যাপকভাবে।
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে ব্রাজিল, চিলি ও পেরুর সাথে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বিশেষ চুক্তি করেছে আফ্রিকায় নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও কেনিয়ার সাথে ।
প্রযুক্তি যেহেতু চীনের অন্যতম বড় হাতিয়ার, সেটার সুযোগ নিতে ছাড়েনি সে। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় ৫জি প্রযুক্তি ও ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তুলছে চীন। হুয়াওয়ে ও জেডটিই (ZTE) আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় স্থাপন করছে টেলিকম নেটওয়ার্ক । আলিবাবা ও টেনসেন্ট ল্যাটিন আমেরিকায় ছড়িয়ে দিচ্ছে ই-কমার্স আর ডিজিটাল পেমেন্ট।
শুধু তথ্যে নয়, প্রযুক্তি খাটছে কৃষিতেও। আফ্রিকার জমিতে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিনিয়োগ আর বিনিয়োগ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অর্থনীতি খানিকটা হোঁচট খেয়েছে। এটা সে নিজেও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তাই সনাতনী পথে না হেঁটে চীন বিনিয়োগ বাড়িয়েছে নতুন আর বিকল্প সব শিল্প খাতে।
তার প্রথম পছন্দ- প্রযুক্তি খাত; অবকাঠামো, মহাকাশ গবেষণা ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে, পাশাপাশি ৫জি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) মতো আধুনিক প্রযুক্তিতেও এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি 'ডিপ সিক' হাজির করে সারা পৃথিবীতে ভালই চমক দেখিয়েছে সে।
আরেকটা বিষয় সে বুঝে গেছে।
যতই আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকাতে অবস্থান বাড়িয়ে জ্বালানি তুলুক না কেন, একদিন পৃথিবীর জ্বালানি ভাণ্ডার ফুরাবেই। যে যত আগে প্রস্তুত থাকবে, ভবিষ্যতের দুনিয়ার দখল তার হাতে থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। সেই জন্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানি প্রযুক্তিতে চীন বিনিয়োগ করছে অস্বাভাবিক অংকের টাকা।
মনযোগ তার অটোমেশনেও।
চীনের বড় বিনিয়োগ আছে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রেও। প্রযুক্তিঘন শিল্পে উৎপাদন হচ্ছে ইলেকট্রিক কার, টেলিকমিউনিকেশন ও আইটি সরঞ্জাম।
নিজের বাজার শক্ত রাখা
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা চীনের রপ্তানিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। তাই তাকে খুঁজতে হয়েছে ভিন্ন উপায়। স্থানীয় বাজারকে শক্তিশালী করে অর্থনীতিকে রপ্তানির উপর কম নির্ভরশীল করতে চাইছে এখন সে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের টানার জন্য চীন বিভিন্ন পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক পর্যন্ত কমিয়ে দিচ্ছে।
গত কয়েক দশকের সমৃদ্ধির সময়ে দেশটিতে গড়ে উঠেছে বিশাল সামর্থবান একটা শ্রেণী। এরা ভাল পণ্য বা সার্ভিসের জন্য মোটা টাকা খরচ করতে রাজি। এদের কনাজম্পশন যদি বাড়ানো যায়, তাহলে বৈদেশিক বাজারের উপর নির্ভরতা কমবে এবং অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসবে। বিলাসবহুল ব্র্যান্ড যেমন Louis Vuitton, Gucci, এবং Rolex-এর বিক্রি এখন বেড়েছে এখানে। Starbucks এবং KFC-এর মতো বিদেশি ফুড চেইনগুলোও চীনে ব্যবসা করছে পুরোদমে।
Regional Comprehensive Economic Partnership (RCEP)-এর সদস্য হয়ে এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানি করছে; এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে কৃষিপণ্য ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি সহজ হচ্ছে।
সাংগঠনিক প্রভাব
জাতিসংঘের তহবিলে এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ অনুদান দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; প্রায় ২৮.৮৯%। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভূমিকাটাই চীনের, ১৫.২১%। তৃতীয় যে জাপান, সে-ও পিছিয়ে আছে অনেকখানি; মাত্র ৮.৫৬%। চীনের অনুদান বাড়ার এই ঘটনাটাও কিন্তু সাম্প্রতিক।
২০১৩ সালে জাতিসংঘ তহবিলে দেশটির অনুদানের পরিমান ছিল যৎসামান্য; মোটে ৭০০ মিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে এই পরিমাণ ৩ গুন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.১ বিলিয়ন ডলার!
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি তার হুমকি মোতাবেক অনুদানের টাকা কমিয়ে দেন, তাহলে নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চ অবস্থানে চলে আসবে চীন।
পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে ২০০৯ এ গড়ে ওঠা জোট BRICS-এও চীনের প্রভাব গভীর। এর মূল লক্ষ্যই আমেরিকান ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমানো।
সেই জন্য গড়েও নেয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংক- আইএমএফ এর বিকল্প। Asian Infrastructure Investment Bank (AIIB) আর New Development Bank (NDB) এর মাধ্যমে বিনিয়োগে অর্থায়নের প্লাটফর্ম থাকায়, পশ্চিমা দেশগুলোর মুখাপেক্ষী আর থাকতে হচ্ছে না তাকে।
এর বাইরেও চীনের নিয়ন্ত্রণে আছে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO - Shanghai Cooperation Organization)। রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে মিলে গড়ে তোলা এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চীন। SCO মূলত আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন এবং বাণিজ্য সহযোগিতার কথা বলে।
এছাড়াও চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে GDI বা Global Development Initiative চালু করেছে।
এই চার কৌশলে বিশ্ব বাজারে প্রভাব বাড়ানো আর মার্কিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজের অবস্থান মজবুত করার কাজ অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে চীন।
রাশিয়াঃ আগ্রাসী এক শক্তি
অর্থনৈতিকভাবে আশির দশকের মত পরাক্রমশালী হয়ত সে আর নয়, কিন্তু সামরিক দিক থেকে এখনো অন্যতম শক্তিশালী দেশ সে।
রাশিয়ার মূল শক্তি তার জ্বালানি সম্পদ।
অর্থনৈতিকভাবে আশির দশকের মত পরাক্রমশালী হয়ত সে আর নয়, কিন্তু সামরিক দিক থেকে এখনো অন্যতম শক্তিশালী দেশ সে।
সাইবার হামলার দক্ষতাতেও তাকে ধরা হয় বিশ্বসেরা।
তবে মূলত জ্বালানি শক্তি ব্যবহার করে সে খবরদারি করে ইউরোপের ওপর। এই জ্বালানি ব্যবহার করেই সে দর কষাকষি করে চীন, ভারত আর মধ্যপ্রাচ্যের সাথে। এর বাইরে অস্ত্র ব্যবসা তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশেই সে অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে।
বিশ্ব বাজারে নিজের অংশীদারিত্ব পাকা করতে রাশিয়ার কৌশলকেও পাঁচ ভাগে ভাগ করে নেয়া যেতে পারে-
ক। জ্বালানি জ্বালানি
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গ্যাসের মজুদ রাশিয়ায়; কয়লায় দ্বিতীয়, আর তেলের ক্ষেত্রে অষ্টম!
আরও আছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশটি বিশ্বের চতুর্থ আর নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে নবম।
ফলে জ্বালানি যে রাশিয়ার হাতে এক বড় হাতিয়ার, তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। সে চাইলে রপ্তানি বাড়াতে পারে, আবার বন্ধও করে দিতে পারে!
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর গ্যাসের চাহিদার ৪৫% যোগান দিত রাশিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ইউরোপের দেশগুলোতে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দিলে ভীষণ বিপদে পড়ে দেশগুলো; বিশেষ করে ফ্রান্স আর জার্মানি। পড়িমরি করে তাদের ছুটতে হয় বিকল্প খোঁজার দিকে আর রাশিয়াও এই সুযোগে মূল্যছাড় দিয়ে খুঁজে বের করে নতুন ক্রেতা।
রপ্তানি বাড়ে চীন, ভারত আর টার্কি'তে; এমনকি সৌদি আরব থেকেও কম দামে গ্যাস দিয়ে জিতে নেয় বাজার। সাইবেরিয়া থেকে চীন পর্যন্ত সরাসরি গ্যাস পৌঁছে দেয়ার বিশাল এক পথও নির্মাণ করে নিয়েছে সে। আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের সাথে করছে দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি চুক্তি।
সাথে সাথে নিউক্লিয়ার জ্বালানি নিয়ে তার দক্ষতা রপ্তানিও করে যাচ্ছে সে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট বসাচ্ছে সে ইজিপ্ট, টার্কি আর বাংলাদেশে। একেকটা চুক্তির মেয়াদ ২০ থেকে ৫০ বছর। তার মানে, একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশগুলোতে রাশিয়ার প্রভাব কার্যকর থাকা!
খ। অস্ত্র যখন খাবার
জ্বালানি নিয়ে রাশিয়া দুনিয়া জ্বালাচ্ছে, সেই সাথে আরও একটা বাড়তি অস্ত্র আছে তার; সেটা হল খাদ্য। আমেরিকা, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়াকে ছাড়িয়ে গম রপ্তানিতে সে বিশ্বের এক নম্বর দেশ। পাশাপাশি তার রপ্তানি তালিকায় আছে কর্ন আর সানফ্লাওয়ার তেল; রাশিয়ার দামের সাথে কোনমতেই পেরে ওঠে না প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো।
রপ্তানি বাড়ানোর জন্য রাশিয়া বেছে নিয়েছে 'নিষেধাজ্ঞা-নিরপেক্ষ' দেশগুলোকে। মানে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব যে সব দেশের ওপর পড়ে না, তাদের।
তার প্রধান ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে ইজিপ্ট, টার্কি, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া আর আফ্রিকার অনেকগুলো দেশ।
খাদ্যকে কিভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তার সাম্প্রতিক নজির রাশিয়া রেখেছে ইউক্রেন যুদ্ধের সময়কালীন। পশ্চিমা চাপে কিছুটা চাপে থাকা দেশটি ২০২৩ সালে বেরিয়ে আসে 'ব্ল্যাক সি গ্রেইন ডিল' থেকে। সাথে সাথে সারা পৃথিবীতে হু হু করে বেড়ে গেল খাদ্যশস্যের দাম। দুনিয়াজোড়া হাহাকারের মধ্যে রাশিয়া আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে বিনে পয়সায় পাঠালো 'খাদ্যশস্য উপহার'! উদ্দেশ্য পরিষ্কার- এই দেশগুলোকে নিজের অনুগত রাখা!
খাদ্য-অস্ত্র আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে রাশিয়া এখন ইরান আর ইন্ডিয়ার সাথে একযোগে কাজ করছে 'নর্থ সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর' নির্মাণের জন্য। ৭,২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বাণিজ্য পথটি ভারত মহাসাগর এবং পারস্য উপসাগরকে কাস্পিয়ান সাগরের সাথে এবং সেখান থেকে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের মাধ্যমে উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপের সাথে যুক্ত করবে।
এই প্রকল্পে চীন না থাকলেও, কিছুটা নিজের স্বার্থে আর কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। ভাবনার অবকাশ থেকেই যাচ্ছে- চীনের 'বিআরআই' নীতির বিরুদ্ধে এই বিশাল করিডোর কোন পালটা পদক্ষেপ নয় তো?
গ। সামরিক বোঝাপড়া
ন্যাটোর সাথে ঝামেলা নিয়ে ইউক্রেন দখল করে নেয়ার রাশান উদ্দেশ্য এখন পুরো পৃথিবীর কাছেই পরিষ্কার। কিন্তু এটা শুধু একটা দিক মাত্র! রাশান সামরিক হস্তক্ষেপ ইউক্রেন ছাড়াও আছে সিরিয়ায়, মালি, মধ্য আফ্রিকা আর সুদানে। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নিউক্লিয়ার অস্ত্রের মজুদও এই দেশে; যার ফলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এতগুলো দেশ একত্র হওয়ার পরেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার আগে দশবার চিন্তা করতে হয়!
সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানিতেও রাশিয়া বিশ্বের শীর্ষে। তার ফাইটার জেট, ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার আর মিজাইলের বড় ক্রেতা- ভারত, চীন, ইজিপ্ট, ভিয়েতনাম আর আফ্রিকার বড় দেশগুলো। এর পাশাপাশি সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সে মধ্য আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকার নানা দেশগুলোকে।
সব মিলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে কোন কঠোর অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে রাশিয়া সব সময় একটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে।
ঘ। প্রযুক্তির রাজনীতি
বদলে যাওয়া দুনিয়ায় পারমানবিক অস্ত্রের পাশাপাশি আরেক অস্ত্র গড়ে উঠেছে; নাম তার- সাইবার সক্ষমতা। আর এই অস্ত্রে রাশিয়ার সমকক্ষ এই মূহুর্তে আর কোন দেশ আছে বলে মনে হয় না। রাশান হ্যাকাররা কেবল বিভিন্ন দেশের সরকারি সিস্টেমেই হামলা চালায় না, সাথে সাথে ঝামেলা পাকায় পাওয়ার গ্রিডে, হাসপাতালে এমনকি নির্বাচনে পর্যন্ত! সস্তায় ড্রোন আর ইলেক্ট্রনিক অয়ারফেয়ার সিস্টেম বানিয়ে বিক্রি করছে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য আর দক্ষিণ এশিয়াতে।
চীনের সাথে একযোগে কাজ করছে নিজস্ব সেমি কন্ডাক্টর আর এআই ডেভেলপমেন্টের কাজেও।
প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল অর্থনীতিতেও বড় পদক্ষেপ নিয়েছে রাশিয়া। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাতেই গড়ে তুলেছে নিজস্ব ক্রিপ্টো কারেন্সি- ডিজিটাল রুবল। উদ্দেশ্য, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর খবরদারি ঠেকানো আর বন্ধু দেশের সাথে ব্যসবসায় ডলার বা ইউরোর উপর নির্ভরশীলতা বন্ধ করা।
ঙ। নতুন সব জোট
জ্বালানি আছে, খাদ্য আছে, অস্ত্র আছে; কিন্তু তারপরও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নানা ছাতা দরকার পড়তেই পারে একটা দেশের। পশ্চিমাদের সমান্তরালে বৈশ্বিক বাজার গড়ে তুলতে আর বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ'র খবরদারি বন্ধ করতে বেশ কিছু জোটে খুবই সক্রিয় আর কৌশলী ভূমিকা রেখে চলেছে রাশিয়া।
BRICS এ রাশিয়া প্রস্তাব তুলেছে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করার।
SCO বা সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে আরও নিবিড় জ্বালানি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে সে।
OPEC+ এর সদস্য হয়ে বিশ্বজোড়া তেলের দামের ওঠাপড়ায় ভূমিকা রাখছে।
EU এর পাল্টা গড়ে তুলেছে Eurasian Economic Union (EAEU)। এতে রাশিয়া ছাড়াও আছে বেলারুশ, কাজাকিস্তান, আর্মেনিয়া আর কিরগিজস্তান।
রাশিয়া-আফ্রিকা ফোরাম আর রাশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকা ফোরাম গঠন করে ঐ অঞ্চলগুলোতে তার অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক প্রভাব বাড়িয়ে তোলার কাজ করছে।
বিশ্ব বাজারের দখলের লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত রাশিয়াকেই অনেক বেশি মরীয়া আর আগ্রাসী মনে হচ্ছে। আমেরিকা অর্থনৈতিক প্যাঁচ কষে বিভিন্ন দেশে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে, চীন এগুচ্ছে 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' নিয়ে আর এর বিপরীতে রাশিয়া জ্বালানি, সামরিক আর খাদ্য- এই তিন অস্ত্র নিয়ে দুনিয়ার প্রায় সব অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নঃ গোকুলে বাড়িছে যে?
অন্যান্য বড় শক্তিগুলোর সাথে টেক্কা দিতে তারা নিজেদের মত করে একটা উপায় বের করে নিয়েছে। হাতিয়ার করেছে নৈতিকতা আর কূটনীতিকে!
আপাতদৃষ্টিতে, এই মূহুর্তে বিশ্ব বাজার দখলের লড়াইয়ে সবচেয়ে নরম শক্তি মনে হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে। খুব বড় হাঁকডাক নেই, যুদ্ধ বা শুল্ক নিয়ে হুমকি-ধমকি নেই, কিন্তু তাই বলে সে হাত গুটিয়ে বসে আছে- এটা ভাবা ভুল।
চীন বা রাশিয়ার বাজার দখলের লড়াইয়ের সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের লড়াই এক নয়। কারণ, তার নিজের মধ্যকার দেশগুলোর নিজস্ব টানাপোড়েন আছে, নিজেদের হিসাব নিকাশের নানা সমীকরণ মিলিয়ে তবে জোট হিসেবে অবস্থান নিতে হয়।
২০২০ সালে ব্রিটেইন যখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছেড়ে চলে গেল, সেটা ছিল আসলেই এক ধাক্কা। এত বড় একটা সামরিক আর অর্থনৈতিক শক্তির অনুপুস্থিতিতে বিশ্ব বাজারের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে নতুন করে ভাবিয়েছে ইউনিয়নকে।
অনিবার্যভাবে, ইইউ এর এই অবস্থা খুশি করেছে আমেরিকাকে।
ব্রিটেইন'র ব্রেক্সিট ত্যাগের পিছনে আমেরিকার সরাসরি হস্তক্ষেপ থাকার কোন মূর্ত প্রমাণ হয়ত নেই কিন্তু সন্দেহ তো থেকেই যায়!
এদিকে ইইউ'র এখনো নিজেকে গুছিয়ে তোলা শেষ হয়নি। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উল্লেখযোগ্য উত্থান ঘটেছে ডানপন্থী দলগুলোর। নিজেদের মধ্যে বাড়ছে মতপার্থক্য। যদিও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ২০২৫ সালের মধ্যেই সংকট কাটিয়ে উঠবে ইউনিয়ন কিন্তু দেশে দেশে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব।
এই পরিস্থিতিতে ইরোপিয়ান ইউনিয়ন ধীরে হলেও কিছু কৌশলে বিশ্ববাজারে তার প্রভাব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ক। বিশ্বব্যপী বাণিজ্য চুক্তি বাড়ানো
বাজার সম্প্রসারণের জন্য উদারনীতি এখন ইইউ'র বড় হাতিয়ার।
দেশে দেশে সে যাচ্ছে 'মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি' বা Free Trade Agreement এর আহ্বান নিয়ে। ইতোমধ্যে সে চুক্তি করেছে জাপান, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম আর মেক্সিকোর সাথে। এই সব চুক্তির প্রধান দিকগুলো হল- নিচু হারের শুল্ক, ইউরোপিয়ান পণ্যের অবাধ বাজার আর নিজস্ব বিনিয়োগের নিরাপত্তা। ল্যাটিন আমেরিকা আর ইন্ডিয়ার সাথেও বাণিজ্য চুক্তির জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে।
এই ছাড়াও তার হাতে আছে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (EPA)। আফ্রিকা, ক্যারিবিয়ান এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সাথে এই চুক্তিগুলো একদিকে মুক্ত বাণিজ্য নিশ্চিত করছে; অন্যদিকে উন্নয়নে সহায়তার নামে ইউরোপিয়ানদের রাজনৈতিক প্রভাব নিশ্চিত করছে।
বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো, ডিজিটাল এবং জ্বালানি প্রকল্পে ৩০০ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের গ্লোবাল গেটওয়ে উদ্যোগ, ইইউ'র আরেকটি কৌশল। এর ধরণ অনেকটা চীনের 'বেল্টস এন রোডস ইনিশিয়েটিভ' এর মত।
খ। ব্রাসেলস এফেক্টে
খেলতে নামার আগে খেলার নিয়ম ঠিক করে দেয়ার সবসময় একটা সুবিধা থাকে।
ইউ অনেকটা তাই করছে। আমেরিকান আর চীনা কোম্পানি যেন অবাধে এসে তার বাজার দখল করতে না পারে, তার জন্য তৈরি করেছে নানা বিধিমালা- সেটা কখনো পরিবেশ বিষয়ে, কখনো প্রযুক্তি বিষয়ে। সেই বিধিমালার সাথে না মিললে, কেউ ব্যবসা করতে পারবে না সেখানে।
নিজের বাজারের বিশাল আকার কাজে লাগিয়ে প্রায়ই সে নানা নিয়ম আরোপ করে দেয়। আর তার সাথে খাপ খাওয়াতে হয় বিশ্বের বাকি দেশগুলোর! যেমন- তথ্য নিরাপত্তায় GDPR (General Data Protection Regulation) কে ইতোমধ্যে সে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিণত করে ফেলেছে। খেয়াল করার মত- রাশিয়া যখন সাইবার অ্যাটাকে নিজের শক্তিমত্তা বাড়ানোর দিকে মন দিয়েছে, তখুনি ইইউ এই GDPR নিয়ে মাঠে নেমেছে।
পরিবেশ বিষয়ে নিয়মকানুন, রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ (যেমন REACH), খাদ্য নিরাপত্তা- এই সমস্ত ক্ষেত্রে ইইউ-এর বিধিমালা বিশ্ববাজারকে প্রভাবিত করছে তো বটেই।
ভবিষ্যতের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি আর অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে এখুনি নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সে। Carbon Border Adjustment Mechanism (CBAM) চালু করে পুরো বিশ্বকে বলছে- যদি উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধব না হয়, তবে ইইউ'তে পণ্য রপ্তানির জন্য বাড়তি কার্বন ট্যাক্স গুনতে হবে!
গ। সামরিক বোঝাপড়া
ন্যাটো নিয়ে আমেরিকার পিছটান, ব্রিটেইন'র ব্রেক্সিট ছেড়ে যাওয়া- সব মিলিয়ে মনে হতে পারে ইইউ এইবার অন্তত সামরিক ক্ষেত্রে ভালই বিপদে পড়েছে। দুনিয়ার এই ধারনা বুঝতে পেরে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। গড়ে তুলেছে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা তহবিল (EDF)। প্রায় ৮ বিলিয়ন ইউরোর তহবিল দিয়ে ২০২৭ এর মধ্যে তারা একদিকে আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম কিনবে, অন্যদিকে চালাবে সামরিক গবেষণা। এই ছাড়া হাতে নিয়েছে কিছু বড় প্রকল্প। যেমন: Future Combat Air System (FCAS)। ফ্রান্স, জার্মানি আর স্পেইনের এই প্রকল্প অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান, ড্রোন, সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং নৌ প্রযুক্তির মতো নিজস্ব উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করবে।
জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন এর ইউরোড্রোন প্রোগ্রাম পাইলটবিহীন যুদ্ধবিমান তৈরি করার কাজ করে যাচ্ছে।
এই সব প্রোগ্রামের দুরবর্তী লক্ষ্য- একদিন বিশ্বব্যাপী অস্ত্র বিক্রির প্রতিযোগিতায় সামিল হবে তারাও। ব্রিটেইন'র সাথে বিচ্ছেদের পরে ইইউ যে সুবিধা পেয়েছে, সেটা হল ইউরোপীয় সেনাবাহিনী গঠন। ব্রিটেইন'র বিরোধিতায় এতদিন এই বাহিনী গঠন করতে পারছিল না ইইউ। এই বছর (২০২৫) এর মধ্যেই ৫,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী তৈরি করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তারা।
সাইবার ও মহাকাশ প্রতিরক্ষা বৃদ্ধি করতে ইইউ হাতে নিয়েছে সাইবার নিরাপত্তা কৌশল। বিশেষ করে রাশিয়ান এবং চীনা হ্যাকারদের সাইবার হামলা থেকে ডিজিটাল অবকাঠামো রক্ষা করতে এই কৌশল।
অন্যান্য শক্তিবর্গ
মেরু আরও আছে। ছোট করে হলেও আছে। এরাও হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের বড় শক্তি।
দুনিয়ার বুকে ইন্ডিয়া দাঁড়াচ্ছে এক স্বতন্ত্র কৌশলে। বড় শক্তিগুলোর প্রায় সবার সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে আদায় করে নিচ্ছে নিজের স্বার্থ। নিজের অর্থনীতিকেও গড়ে তুলছে মজবুত করে। আইটি আর সফটওয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে এই মুহুর্তে নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশটি। চীন থেকে নানা কারখানা সরিয়ে আনছে নিজের দেশে (যেমন, এপল বা টেলসা)। তৈরি করছে নিজস্ব অস্ত্র আর মহাকাশ প্রযুক্তি। ব্রিকস, ইন্ডিয়ার অন্যতম শক্তিশালী প্লাটফর্ম। পশ্চিমা বড় অর্থনীতির আধিপত্যের বিরুদ্ধে ভালই চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে এই সংস্থা। আবার একই সময়ে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাথে সম্পর্ক মজবুত করছে, রাশিয়ার কাছ থেকেও তেল কিনছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে স্বাধীন কৌশল নিচ্ছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত নতুন মিত্র খুঁজছে মরীয়া হয়ে। একদিকে চীনের সাথে বাণিজ্য ও জ্বালানি চুক্তি করছে, রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক মজবুত করছে (তেল উৎপাদনে সহযোগিতা করছে); অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে বসে না থেকে নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলছে।
আর তুরস্ক সচেষ্ট সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর দিকে। নজর তার মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ায়; সেখানে বাড়ছে তার সামরিক উপস্থিতি। নিজেই তৈরি করছে উন্নতমানের ড্রোন সহ নিজের অস্ত্র, রপ্তানি করছে বাইরেও।
এই নানা কেন্দ্রিক যুদ্ধ অন্যান্য দেশগুলোর জন্য একই সাথে সংকট, একই সাথে সম্ভাবনা। সম্ভাবনা, কারণ, তার দর কষাকষির সুযোগ এখন অনেক বেশি। সংকট, কেননা, কোন সিদ্ধান্তে কে কোথায় চটবে, আন্দাজ করা মুশকিল। নানান দেশ নানান উদ্দেশ্যে এখন শক্তিশালী অর্থনীতির সাথে জোট বাঁধছে।
চীনের সাথে রাশিয়া, ইরান ও আফ্রিকার কিছু দেশ যুক্ত হয়েছে, কারণ তারা বাণিজ্য ও জ্বালানিতে বিকল্প ব্যবস্থা গড়তে চায়।
নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিতে সহযোগিতার হাত নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়েছে ইউরোপের একাংশ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন চাইছে আমেরিকা আর চীনের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিতে। কিন্তু রাশিয়ার একগুঁয়েমি আবার সে কোনমতেই সামাল দিতে পারছে না।
সব মিলে যে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এখনো কোন গতিমুখ তৈরি হয়নি। তবে নিঃসন্দেহে, এত সব খেলোয়াড়ের মধ্যে প্রধান দুই শক্তি হল- আমেরিকা আর চীন। তাদের দ্বন্দ্বের ধরণ ঠিক করে দেবে আগামী পৃথিবীর চেহারা।


