অস্থির আফ্রিকাঃ ইউরোপীয়ানদের লোভের বলি

Asad_USA
দুর্ভিক্ষ, গৃহযুদ্ধ, ক্যু- এই যেন আফ্রিকান দেশগুলোর অনিবার্য নিয়তি! এর জন্য স্পষ্টতই দায়ী ইউরোপীয়ান সাম্রাজ্যবাদের লোভ।

সুদান, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়ায় চলছে গৃহযুদ্ধ।

মালি, চাদ, বুরকিনা ফাসো, নাইজার সহ আরও কয়েকটি দেশে চলছে সামরিক শাসন।

দুর্ভিক্ষ, গৃহযুদ্ধ, ক্যু- এই যেন আফ্রিকান দেশগুলোর অনিবার্য নিয়তি!

এর পিছনে স্পষ্টতই দায়ী ইউরোপীয়ান সাম্রাজ্যবাদের লোভের ফলাফল- 'স্ক্র্যাম্বল অফ আফ্রিকা'। মানে, আফ্রিকা নিয়ে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

স্ক্র্যাম্বল শব্দের ব্যবহারটা এখানে বেশ মজার। ইংরেজি শব্দটার ঠিক আক্ষরিক বাংলা প্রতিশব্দ হয়ত এই; কাছাকাছি একটা অর্থ হতে পারে- উল্টেপাল্টে দেয়া। যেমন আমরা 'স্ক্র্যাম্বল' খেলায় অক্ষর উল্টেপাল্টে শব্দ তৈরি করি; বা ক্রমাগত ঘুঁটে ঘুঁটে 'স্ক্র্যাম্বলড এগ' রান্না করি। আফ্রিকার সব সীমানা তেমনি করে উল্টেপাল্টে দিয়েছিল সাত ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদী দেশ।

সময়টা ছিল নয়া সাম্রাজ্যবাদের; উনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে এর শুরু।

১৮৭০ সালে আফ্রিকার ১০% অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত ইউরোপিয়ানরা। ১৯১৪ সালের মধ্যে নিয়ন্ত্রণভুক্ত এলাকা দাঁড়াল ৯০% এ!

এই সময়ের মধ্যে ইউরোপিয়ান ঐ সাত দেশ পড়িমরি করে ছুটেছে; কে কার আগে কোন জায়গা দখল করবে, সেই প্রতিযোগিতায়। নিজেদের মত দেশ দখল করে, নিজেদের ইচ্ছেমত সীমানা ঠিক করেছে তারা। এই সীমানা নির্ধারণে স্থানীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি- কিছুই মাথায় রাখা হয়নি; এমনকি কথা বলা হয়নি কোন আফ্রিকান নেতার সাথেও!

আর তার চেয়েও অবাক করার ব্যাপার হল, সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পরেও দেশগুলো সেই উপনিবেশিক সীমানা রেখে দিয়েছে। ১৯৬৪ সালে অর্গানাইজেশন অফ আফ্রিকান ইউনিটি'র সম্মেলনে এই ব্যাপারে ঐকমত্যে আসে তারা।



আফ্রিকান দেশগুলোর নিজেদের দ্বন্দ্ব বা বিতর্ক অন্য আলাপ

প্রশ্ন হল, সেই যে ১৮৭০ সাল থেকে ইউরোপিয়ানরা আফ্রিকা দখলের খেলায় মেতে উঠল, তার পেছনের কারণটা আসলে কি?

সেই ১৮৭০ এ ভারতবর্ষে ব্রিটেন দোর্দন্ড প্রতাপে শাসন করে যাচ্ছে, ল্যাটিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশ ইতোমধ্যে স্বাধীন হয়ে উঠেছে। আর সেই সময় কি না আফ্রিকা দখল শুরু করল ইউরোপিয়ানরা! এর পেছনে একটা বড় কারণ বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত। শুরু হয়েছিল ভিয়েনা'র স্টক মার্কেট ধ্বস দিয়ে; তার ঢেউ লেগে দেউলিয়া হয়ে গেল আমেরিকান ব্যাংক জে কুক এন্ড কোম্পানি। অতি উৎপাদনে মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল, বেকারত্ব বাড়ছিল, দেশে দেশে বাড়ছিল অস্থিরতা। সেই সময় নতুন বাজারের জন্য মরীয়া সাম্রাজ্যবাদ ছুটে গিয়েছিল আফ্রিকায়।

আরও আগে কি যেতে পারত না তারা? যায়নি কেন?

যায়নি বললে ভুল বলা হবে। গেছে, কিন্তু দেশ দখল করার জন্য নয়; দাস সংগ্রহের জন্য।

১৮০০ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকা-ইউরোপসহ সমস্ত জায়গায় দাস ব্যবসা আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন নজর যায় এই মহাদেশের স্বর্ণ, হীরা, রাবার আর পাম অয়েলের মত সম্পদের দিকে।

কিন্তু তবু দেশ দখল শুরু হয়নি তখুনি। কেন? ভয়ে। ম্যালেরিয়ার ভয়।

১৮৪১ সালের আগে গুটি গুটি পায়ে ইউরোপিয়ানরা আফ্রিকায় গেলেও থাকত মূলত সাগরের পাড় ঘেঁষে; মুল ভূখণ্ডে যেত না। ম্যালেরিয়া একদম নিতে পারত না তাদের শরীর। টপাটপ মরে যেত। কুইনাইন যখন বাণিজ্যিকভাবে সহজলভ্য হয়ে উঠল, ভরসা আসল মনে।

এই যে সাম্রাজ্যবাদীরা এসে উল্টেপাল্টে দিল আফ্রিকা'কে, তার পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে এখনো। এক নজরে 'স্ক্র্যাম্বল অফ আফ্রিকা'র ফলগুলো দেখে নেয়া যাক-

  • ১. ভুলভাবে সীমান্ত তৈরি আর তার ফলে গড়ে ওঠা জাতিগত দ্বন্দ্ব

ইউরোপীয়ান দেশগুলো নিজেদের সুবিধামতো মানচিত্র একে আফ্রিকার বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে নেয়। এতে একই জাতিগোষ্ঠী হয়ে যায় আলাদা আলাদা দেশের অংশ, আবার আপাত শত্রুতা ছিল যেসব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে, তাদের রাখা হয় একসাথে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি জাতিগত সংঘর্ষ ও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। রুয়ান্ডা গণহত্যা বা সুদানের সংঘর্ষের পিছনের মূল কারণ এখানেই।

  • ২. সম্পদ লুটপাটের কারণে দুর্বল অর্থনীতি

নিজেদের সম্পদের মালিক হতে পারেনি আফ্রিকার মানুষ। তাদের অর্থনীতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ইউরোপের ওপর । লুট হয়ে গেছে এখানকার সোনার খনি, হীরা, তেল, রাবার, হাতির দাঁত ইত্যাদি। ইউরোপের বাজারের জন্য স্থানীয় কৃষকদের দিয়ে জোর করে কফি, তুলা, কোকো উৎপাদন করানো হত।

  • ৩. আফ্রিকার রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস

টিকে থাকার স্বার্থে ইউরোপীয়ানরা ধ্বংস করে দেয় স্থানীয় শাসন কাঠামো। যার রেশ থাকে স্বাধীনতার পরও। দুর্নীতি, সামরিক শাসন, ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে আফ্রিকায়।

  • ৪. সংস্কৃতির আগ্রাসন

ইউরোপীয়ান শাসকরা নিজেদের ভাষা, শিক্ষা ব্যবস্থা ও ধর্ম চাপিয়ে দেয় আফ্রিকার জনগণের ওপর। অবহেলিত হতে থাকে নিজস্ব ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি ।

  • ৫. মানবাধিকার লঙ্ঘন

বিশেষ করে খনি ও রাবার সংগ্রহের জন্য ইউরোপীয়ানরা জোর করে আফ্রিকার মানুষকে শ্রম দিতে বাধ্য করে। বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ডের শাসনে কঙ্গোতে প্রায় ১ কোটি মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়। অনেক জায়গায় বিদ্রোহ দমন করতে গণহত্যা চালানো হয়।

  • ৬. বেকার অবকাঠামো

রেলপথ, সড়ক ও বন্দর বানানো হয়েছিল শুধুমাত্র সম্পদ লুটপাটের জন্য। স্থানীয় মানুষের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা কল্যাণমূলক কিছুই করা হয়নি। ফলে স্বাধীনতার পরও অনেক আফ্রিকান দেশ দারিদ্র্য ও পশ্চাদপদতায় ভুগছে।

  • ৭. গৃহযুদ্ধ ও দুর্নীতি

ডিভাইড এন্ড রুল চলেছে আফ্রিকাতেও। ইউরোপীয় শাসকরা আফ্রিকা ছেড়ে যাওয়ার সময় ক্ষমতার জন্য দ্বন্দ্ব তৈরি করে রেখে যায়। তাই ১৯৫০-৭০ সালের মধ্যে আফ্রিকার দেশগুলো স্বাধীনতা পেলেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব ছিল। ফলে অনেক দেশে সামরিক শাসন, গৃহযুদ্ধ, ও দুর্নীতি দেখা দেয়। সোমালিয়া, কঙ্গো বা সুদান এর বড় উদাহরণ।

পড়ে দেখতে পারেন