যন্ত্রবুদ্ধিতে পাল্টে যাচ্ছে বিশ্বের চেহারা
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর বাংলা করা হয়েছে 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা'।
খটমটে শোনালেও শব্দগুচ্ছের মানে কিন্তু অনেক গভীর। বুদ্ধি, কিন্তু কৃত্রিম!
আর এই কৃত্রিম বুদ্ধিতে সেরা হওয়ার লড়াই শুরু হয়ে গেছে দুনিয়াজুড়ে।
সবার বিশ্বাস, ভবিষ্যতের অর্থনীতি, সামরিক কতৃত্ব, আর ভূরাজনীতিতে মাতবরি- সবই নির্ভর করছে এই এআই প্রযুক্তির ওপর। এই নিয়ে যে লড়াই, সেটা সাদা চোখে দেখা যাওয়া মুশকিল; কেননা, এখানে কেউ কারো উপর অস্ত্র বোমা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে না। যুদ্ধ চলছে এলগরিদমে, সুপারকম্পিউটারে, আর নীতিমালা নিয়ে। লড়াইয়ের অন্যতম পাঁচটি পক্ষ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, রাশিয়া আর বড় টেক কোম্পানিরা। প্রত্যেকের আছে নিজস্ব এজেন্ডা আর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা; একজনের সাথে আবার আরেকজনেরটা মেলানো যায় না!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রঃ সিলিকন ভ্যালির নেতৃত্বে
বড় টেক কোম্পানির কারণে আমেরিকা এমনিতেই এআই গবেষণায় এগিয়ে আছে।
গুগল আমেরিকান কোম্পানি, মাইক্রোসফট আমেরিকান, ওপেন এআই আমেরিকান; অ্যাপল আর মেটা'ও তাই।
এতসব বড় টেক কোম্পানির কারণে আমেরিকা এমনিতেই এআই গবেষণায় এগিয়ে আছে। এই কোম্পানিগুলোর হাতেই অসম্ভব সব কাজ হয়েছে; চ্যাট জিপিটি'র মত ভাষা কাঠামো (language models) তৈরি হয়েছে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলা গাড়ি তৈরি হয়েছে, শুরু হয়েছে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং।
এই ক্ষেত্রে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে কিছু পদক্ষেপও নিতে হয়েছে তাদের।
২০২০ এর ন্যাশনাল এআই ইনিশিয়েটিভ অ্যাক্ট আর ২০২২ এর চিপস এন্ড সায়েন্স অ্যাক্ট জারি করে বিদেশ নির্ভরতা কাটিয়ে প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়াও, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এআই স্ট্র্যাটেজি মনযোগ দিয়েছে সামরিক এআই এর উপর। স্বয়ংক্রিয় ড্রোন, সাইবার নিরাপত্তা আর এআই নজরদারি নিয়ে কাজ করছে রাতদিন।
এত সবের পরেও তার জন্য বড় হুমকি এই ক্ষেত্রে চীনের অগ্রগতি। এছাড়াও নিজ দেশে এআই এথিকস নিয়ে বিতর্ক, তথ্যের প্রাইভেসির অধিকার ইত্যাদি বিতর্কে অনেক গবেষণাই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
চীনঃ উদীয়মান পক্ষ
২০৩০ এর মধ্যে এআই দুনিয়ায় বিশ্ব সেরা হয়ে উঠবে চীন!
প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং ঘোষণাই করেছেন, চীনের জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে এআই।
২০১৭ সালে নেয়া 'নেক্সট জেনারেশন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান' এ ঠিক করা হয়েছে- ২০৩০ এর মধ্যে এআই দুনিয়ায় বিশ্ব সেরা হয়ে উঠবে চীন। এর জন্য কাজ করে যাচ্ছে চাইনিজ বড় টেক কোম্পানিগুলো- আলিবাবা, বাইডু, টেনছেন্ট আর হুয়াওয়ে। মুখ দেখে চেনার জন্য ফেশিয়াল রিকগনিশন, স্মার্ট শহর আর এআই ভিত্তিক কারখানা নিয়ে উদ্ভাবনী গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
চীনের এআই নীতিমালা অনুযায়ী-
- ক। এআই ট্রেনিং এর জন্য কোন প্রাইভেসির বালাই না রেখে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে যাচ্ছে
- খ। সামরিক ক্ষেত্রে এআই নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র আর নজরদারই ব্যবস্থা নিয়ে কাজ চলছে
- গ। এআই কন্টেন্টের ওপর রয়েছে কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ
এআই প্রযুক্তি, বিশেষ করে সেমি কন্ডাক্টর নিয়ে আমেরিকা আর চীনের মধ্যে রীতিমত ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে। চীনের এআই চিপ আমদানির উপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। আর চীনও নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিয়েছে। হুয়াওয়ে'র তৈরি চিপ ব্যবহার করছে তার ডেটা সেন্টারে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নঃ মূল্যবোধ আর ক্ষমতার টানাপড়েন
এই নীতিমালার কারণেই এআই উদ্ভাবনের দৌড়ে পিছিয়ে গেছে ইইউ।
ইইউ আবার নজর দিয়েছে একটু ভিন্ন দিকে।
প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রতিযোগিতায় না নেমে সে তুলে ধরছে এআই'র ওপর লাগাম পরানোর এথিকাল দিকটা। ২০২১ সালে উপস্থাপন করা 'ইইউ এআই অ্যাক্ট' এর মাধ্যমে সে হাজির করেছে এআই রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক; যার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যাবে যে- এআই উন্নয়ন হবে এথিকাল, ন্যায়সঙ্গত আর নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার সংরক্ষণ করে।
মুশকিল হল, এই নীতিমালার কারণেই এআই উদ্ভাবনের দৌড়ে পিছিয়ে গেছে ইইউ।
ইউরোপিয়ান এআই কোম্পানিগুলো পেরে উঠছে না সে আমেরিকা বা চীনের বড় কোম্পানিগুলোর সাথে। জার্মানি এবং ফ্রান্স এআই উন্নয়নে যদিও জোর চেষ্টা করার কথা ভেবেছে, কিন্তু সমন্বিত এআই স্ট্র্যাটেজির অভাবে সে বেশিদূর এগুতে পারছে না।
রাশিয়াঃ সামরিক এআই এবং সাইবার যুদ্ধ
পুরনো প্রযুক্তি, পশ্চিমা দেশগুলোর অবরোধও তার অগ্রগতির পথে বাধা।
পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া এআই'কে করে তুলতে চায় আগামীদিনের যুদ্ধের হাতিয়ার।
তাই সাইবার যুদ্ধ, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আর গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে এআই'কে আরও উপযোগী করে তুলতে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করছে সে। রাশিয়ার সাইবার ইউনিটের কাজের ধরণ এর মধ্যে জেনে গেছে সবাই। বিশ্ব রাজনীতি বা ইলেকশনে প্রভাব তৈরির জন্য এই ইউনিট অপতথ্য ছড়ানো, হ্যাকিং আর ডিপফেইক টেকনোলজি কাজে লাগায়।
কিন্তু যেহেতু, তার প্রাইভেট সেক্টর তেমন শক্তিশালী নয়, তাই বাণিজ্যিকভাবে এআই ডেভেলপমেন্টে সে পিছিয়ে আছে। পুরনো প্রযুক্তি, পশ্চিমা দেশগুলোর অবরোধও তার অগ্রগতির পথে বাধা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তিগত সহযোগিতার পথও গেছে অনেক সংকুচিত হয়ে।
প্রাইভেট টেক জায়ান্টসঃ অদৃশ্য মহাশক্তি
শুধু সরকারগুলোর হাতে আর এআই'র নিয়ন্ত্রণ নেই।
এআই নীতিমালা তৈরি আর বিশ্বব্যপী নিয়ন্ত্রণে গুগল ডিপমাইন্ড, ওপেন এআই, মাইক্রোসফট আর আমাজন'র ভূমিকা রাখার সুযোগ ও ক্ষমতা অনেক বেশি। প্রায়ই এই কোম্পানিগুলোকে নানা অভিযোগের তির মোকাবিলা করতে হয়; যার মধ্যে আছে- এআই এর কারণে মানুষের কাজ হারানো, অপতথ্য আর প্রাইভেসির ইনভেশন। জাতীয় স্বার্থে কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের গলদঘর্ম হতে হয় হামেশাই।
কার সাথে কার কি দ্বন্দ্ব?
এই পাঁচ পক্ষের মধ্যে নানারকম দ্বন্দ্ব আর সংকট আছে।
ক। মার্কিন-চীন শীতল যুদ্ধ
এআই সংক্রান্ত ভূরাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ঝামেলা পেকে আছে আমেরিকা আর চীনের মধ্যে। চীনে এআই চিপ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে রেখেছে মার্কিনীরা। এনভিডিয়া'র মত বড় কোম্পানিকেও বলে দেয়া আছে, কোন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এআই চিপ যেন চীনের কাছে বিক্রি করা না হয়। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে নিজস্ব সেমিকন্ডাক্টর শিল্প গড়ে তোলায় মন দিয়েছে চীন।
এআই ব্যবহার তাই বলে থেমে নেই উদীয়মান এই পরাশক্তির। রাষ্ট্রীয় নজরদারি, উঘুরে মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড বা সাইবার গোয়েন্দাগিরিতে চীন এআই ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশটির বড় টেক কোম্পানিগুলো নিষেধাজ্ঞার খড়গে পড়েছে আমেরিকা আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে।
খ। সামরিক দ্বন্দ্বে এআই
আধুনিক যুদ্ধের চেহারা পাল্টে দিচ্ছে এআই। স্বয়ংক্রিয় ড্রোন, অস্ত্র চালনা বা যুদ্ধক্ষেত্রের নানা তথ্য সংগ্রহ- এগুলো এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা করে দেখিয়েছে এআই'র অন্যরকম ব্যবহার। মিজাইলের গতিপথ ঠিক করতে, ডিপফেইক প্রচারণা চালাতে আর সাইবার আক্রমণে কাজে লাগিয়েছে তারা এই প্রযুক্তি। আর সেটা ঠেকাতে বাইডেনের আমেরিকা আর ন্যাটো মিলে তৈরি করার চেষ্টা করেছিল এআই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
জাতিসঙ্ঘ ইতোমধ্যে 'স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র' (lethal autonomous weapons) নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু কোন বড় দেশই এখন পর্যন্ত ঐ ধরনের কোন প্রস্তাবনায় স্বাক্ষর করেনি।
গ। অর্থনীতি আর সাইবার দ্বন্দ্বে এআই
বাণিজ্য যুদ্ধে এআই'কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় বিশ্ব অর্থনীতির লড়াইও নতুন চেহারা নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) মার্কিন এআই কোম্পানির ওপর বসিয়েছে ডিজিটাল কর। আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এআই চিপ ও সেমিকন্ডাক্টরের সরবরাহ ব্যবস্থা আলাদা করতে টেক যুদ্ধ চালাচ্ছে।
এআই নির্ভর হ্যাকিং সাইবার নিরাপত্তার হুমকি বাড়াচ্ছে। চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র প্রায় সারাক্ষণই একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে সাইবার গোয়েন্দাগিরি আর অপতথ্য ছড়ানোর।
এআই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ
দুনিয়া জুড়ে এআই নিয়ে প্রতিযোগিতা কেবল প্রযুক্তিগত বিষয় নয়।
- নিয়ন্ত্রণ বনাম উদ্ভাবন
- সামরিক ও নিরাপত্তায় এআই
- অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এআই
- সহযোগিতা বনাম প্রতিযোগিতা
বিশ্ব এখন দুটি শিবিরে বিভক্ত—একদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) কঠোরভাবে এআই নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা চালু করছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এআই উদ্ভাবনে কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না। উন্নয়নের আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই হবে আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ।
জাতিসঙ্ঘ যতই সাবধান করুক, কিথা শুনছে না কেউ। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও এআই নির্ভর সাইবার আক্রমণের আশঙ্কা বাড়ছে প্রতিদিন। আগামীদিনের বিশ্ব রাজনীতিতে এটা বড় জটিলতা ডেকে নিয়ে আসবে।
যে দেশ এআই প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দেবে, তার হাতেই বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ থাকবে। বাণিজ্য নীতি, শ্রম বাজার এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসবেই।
এআই নিয়ে প্রতিযোগিতা যেমন রয়েছে, সহযোগিতার উদাহরণও বিরল নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এআই নীতিমালা নিয়ে সংলাপ কিন্তু অব্যাহত রেখেছে। এই আলোচনা কতদূর এগুবে, সেটা নির্ভর করবে রাজনীতির উত্তাপের পারদের উপর।
দুনিয়া জুড়ে এআই নিয়ে প্রতিযোগিতা কেবল প্রযুক্তিগত বিষয় নয়। এটা আসলে লড়াই; ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্যের লড়াই। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন নেতৃত্ব এই ক্ষেত্রে আপাতত নেতৃত্ব দিচ্ছে, তবে ইউরোপ, রাশিয়া এবং বড় বড় বেসরকারি কোম্পানিগুলোও বসে নেই। এআই বৈশ্বিক সহযোগিতা গড়ে তুলবে, নাকি ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আরও গভীর করবে, তা এখনো নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট— আগামী শতাব্দীর গতিপথ ঠিক করে দেবে এআই। এআই'র নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে, তার হাতেই তৈরি হবে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ।
ভাল কথা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর বাংলা 'যন্ত্রবুদ্ধি' কেমন শোনায়?


