মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ, তেলের নয় পানির?

Asad_USA
পানি আর রাজনীতি মিশলে পরিণাম ভাল হয় না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে!

এই যে প্রতিদিন এত এত সংবাদ- ইজরাইল-প্যালেস্টাইন-সিরিয়া-জর্ডান-লেবানন-ইরান-ইরাক; এই সব জায়গায় ঝামেলা লেগেই থাকে। সে কি কেবল তেলের জন্য? ধর্মের জন্য? সবই কি কেবল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র? হয়ত তেলও কিছুটা দায়ী, দায়ী ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, এমনকি দায়ী হতে পারে আমেরিকাও।

কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে 'পানি-যুদ্ধ'। আগামীদিনের প্রায় সব যুদ্ধে ধীরে ধীরে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে যাচ্ছে 'পানি'।

কি করে?

নোনা পানি সাগরের, ব্যবহার করা যায় না। মিঠা পানি থাকে নদীতে, ভূগর্ভে আর পাহাড়ি ঝর্ণায়; সেটাই মানুষ ব্যবহার করে। সারা পৃথিবীর মিঠা পানির মাত্র ১% আছে মধ্যপ্রাচ্যে। এই পানি দিয়ে মেটাতে হয়ে পৃথিবীর জনসংখ্যার ৫% এর চাহিদা! সেই জন্য এখানে পানি নিয়ে উত্তেজনার শেষ হয় না।

পানি নিয়ে গ্যাঞ্জাম ঐতিহাসিক

এই অঞ্চলে পানি নিয়ে যুদ্ধের সবচেয়ে পুরনো ঘটনার কথা যেটা জানা যায়, সেটা খ্রিস্টের জন্মের ২৪০০ বছর আগের; সুমেরীয় সভ্যতার সময়। উম্মা আর লাগশ নামের দুটো শহরের মধ্যে যুদ্ধ বেধেছিল সেচ ব্যবস্থায় টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর পানি ব্যবহার নিয়ে। সাড়ে চার হাজার বছর পরেও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পানি নিয়ে উত্তেজনা একটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি হালের ত্রাস ইসলামিক ষ্টেট, আইএস পর্যন্ত টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে। ইরাকের মসুল বাঁধের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মোটামুটি যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। কখনো বাঁধ আটকে পানি যেতে দেয় না, কখনো বাঁধ খুলে দিয়ে গ্রামকে গ্রাম বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে।

আরব আমিরাত

আরব আমিরাত পরিচিত তার চকচকে শহরগুলোর জন্য। অনেকে মনে করে, ধনী দেশের আবার পানি সমস্যা কি! কিন্তু গত ৩০ বছরে দেশটির ভুগর্ভে পানির স্তর প্রতি বছর ১ মিটার করে নিচে নেমে গেছে। এভাবে চললে, আর মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে আরব আমিরাতের প্রাকৃতিক পানির মজুদ শেষ হয়ে যাবে।

ইরাক

পানি নিয়ে সবচ্যে বড় ক্যাচালে আছে ইরাক। মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রধান নদী টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিসের মূল ধারা তো এই দেশের মধ্য দিয়েই বয়ে গেছে। কিন্তু তার এলাকায় ঢোকার আগেই উজানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বানিয়ে বাঁধ দিয়ে বসে আছে টার্কি, ইরান আর সিরিয়া। ফলে নদীতে পানি আসে না পর্যাপ্ত, কৃষিকাজ পড়েছে দারুণ ঝামেলায়। আর যুদ্ধের ধকল তো আছেই। মার্কিন হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ইরাকের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট।

জর্ডান

জর্ডানের সমস্যা প্রায় একই রকম। তার জর্ডান আর ইয়ারমুক নদীর উজানে ইজরাইল আর সিরিয়া পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় বিপদে পড়েছে দেশটি। তার উপর বৃষ্টি কমে গেছেম দ্রুত ফুরাচ্ছে ভুগর্ভস্থ পানি।

সিরিয়া

২০২১ সালে সিরিয়ার উত্তরপুর্বের ইউফ্রেটিস নদীর প্রবাহ রেকর্ড পরিমাণ কমে শুরু হয়েছে খরা। এর বড় কারণ উজানে টার্কি বাঁধ বসিয়ে পানি টেনে নিচ্ছে। আর ইজরায়েলের কাছে পানি হারানো তো অন্যতম বড় কারণ। সিরিয়া চায় ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগের সীমানায় ফিরে যেতে যাতে সে জর্ডান আর ইয়ারমুক নদীর পানি ব্যবহারের সুযোগ পায়। ইজরাইল চায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অনুযায়ী ১৯২৩ সালের সীমানা, যেখানে ইজরাইলকে এই এলাকাগুলো দিয়ে দেয়া হয়েছিল।

ইজরাইলঃ সবচেয়ে বড় পানি সন্ত্রাসী

ইজরাইল এই মধ্যপ্রাচ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসা দেশ। সে নিয়ে এসেছে লাখ লাখ শরনার্থী। তারা এসে ভাগ বসিয়েছে এই অঞ্চলের পানিতে। নিজেদের অস্তিত্ব টিকাতে হামলা করেছে অপর দেশের পানি সম্পদে।

প্রথম মাস্তানি করে বড় সফলতা পেয়েছে সে ১৯৬৭ সালে। জর্ডানের সাথে নদীর পানি প্রবাহ নিয়ে চলতে থাকা বিবাদ গড়াল যুদ্ধে। 'ছয় দিনের যুদ্ধে' পশ্চিম তীর আর টাইবেরিয়া লেকের ওপর দখল নিয়ে তার দেশের মিঠা পানির ৬০% এর যোগান নিশ্চিত করে ফেলল ইজরাইল। এদিকে পানি হারাল প্যালেস্টাইনের কৃষকরা। ইজরাইল নিজের জন্য কিন্তু আবার নিয়েছে বাণিজ্যিক কৃষি প্রকল্প, যার জন্য দরকার প্রচুর পানি। পশ্চিম তীরের পানির ৮০% দখলে নিয়ে প্যালেস্টাইনকে দিয়েছে মাত্র ২০%। কিন্তু প্যালেস্টাইনিরা বলছে, সেই পানিও তারা সংগ্রহ করতে পারে না। কারণ একদিকে দেয়াল তুলে পানির ক্ষেত্রগুলো আড়াল করা হয়েছে, তার ওপর পাহারায় থাকে হিংস্র ইজরাইলই সেনা সদস্যরা। লক্ষ লক্ষ মানুষকে তারা বাধ্য করে চড়া মূল্যে পানি কিনে নিতে।

প্যালেস্টাইন নিয়ে দুনিয়াজোড়া মানুষের মতামতকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ইজরাইল এখনো এগুচ্ছে নিজের মত করে। আরবরা সেই জন্যই হয়ত বলে- ইজরাইল যেন স্পঞ্জের মত; আরব দেশগুলোর পানি শুষে নিয়ে যাচ্ছে।

  • সারা পৃথিবীর মিঠা পানির মাত্র ১% আছে মধ্যপ্রাচ্যে।
  • এই অঞ্চলে পানি নিয়ে গ্যাঞ্জাম শুরু ৪৫০০ বছর আগে
  • আর মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে আরব আমিরাতের প্রাকৃতিক পানির মজুদ শেষ হয়ে যাবে।
  • পানি নিয়ে সবচ্যে বড় ক্যাচালে আছে ইরাক।
  • পশ্চিম তীরের পানির ৮০% দখলে নিয়ে প্যালেস্টাইনকে দিয়েছে মাত্র ২০%।
  • পড়ে দেখতে পারেন