চীনও কি আর্থিক সংকটে হিমশিম খাচ্ছে?

Asad_USA
চীনের অর্থনৈতিক উত্থান শেষ হয়েছে। ২০০৭ সালে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশের বেশি ছিল, ২০২৩ সালে নেমে এসেছে ৬ শতাংশের নিচে।

চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের স্বর্নযুগ তাহলে শেষ হয়েছে!

দেশের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, বড় কোম্পানিতে ধ্বস নামছে, বাড়ছে বৈদেশিক ঋণ!

২০০৭ সালে যেখানে দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশের বেশি ছিল, ২০২৩ সালে তা কমে ৬ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠান Institute of International Finance-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে চীনের মোট ঋণের পরিমাণ (দেশীয় ও বৈদেশিক উভয়ই) জিডিপির ৩৬৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এই হার কতটা বড়, সেটা বোঝার জন্য আর কয়েকটা দেশের উধারণ টেনে দেখা যাক। একই সময়ে ব্রাজিলের ঋণ ২০৮ শতাংশ, আর্জেন্টিনার ১৫২ শতাংশ আর ইন্দোনেশিয়ার ৮৬ শতাংশ।

এই কয়েক বছর আগেও চীনের অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রতীক ছিল রিয়েল এস্টেট কোম্পানি- 'এভারগ্রান্ডে'। আবাসন বাজারে মন্দার ফলে আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এত বড় কোম্পানি!

হঠাত করেই চীন এমন সমস্যায় পড়েছে, ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়।

গত তিন দশকে দেশটি বেশ কয়েকবার অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। কারণ কখনো অভ্যন্তরীণ ; কখনোবা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধাক্কা। সংকট এসেছিল ১৯৯২-৯৩ তে অভ্যন্তরীণ কারণে; ১৯৯৭-৯৮ তে ধাক্কা দিয়েছিল এশীয় অর্থনৈতিক সংকট; আর ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের প্রভাব তো ছিলই।

প্রতিবারই চীন দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, কারণ সরকার দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে সময়মত।

১৯৯২-৯৩ তে অতিরিক্ত উৎপাদন আর জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি সংকট টেনে এনেছিল। তাই ১৯৯৪ সালে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ঝু রোংজি হাতে নিয়েছিলেন ব্যপক সংস্কার পরিকল্পনা।

১৯৯৭-৯৮ এর সংকটের ফলশ্রুতিতে ২০০১ সালে যোগ দেয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO)। আর ২০০৮ এর সংকটের পরে দ্রুত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে চাঙ্গা করে তোলে অর্থনীতিকে । পুরনো এতসব রেকর্ডের কারণে এমন বিশ্বাস জন্মানো স্বাভাবিক যে- চীন সরকার আবারো সেই ‘জাদু’ দেখাবে; আবার গতি আনবে অর্থনীতিতে।

কিন্তু এবারকার সংকট আগের যে কোন সময়ের তুলনায় গভীর। এর সমাধান আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন হতে পারে।



সাম্প্রতিক সংকট

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-ও সতর্ক করেছিল যে, এই প্রণোদনা চীনে মূল্যহ্রাস (deflation) ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

এই দফায় চীনের অর্থনৈতিক মন্দার শুরু হয়েছিল ২০১০-এর দশকের শুরুতেই।

সেটা সামলাতে না সামলাতেই এসে পড়ে কোভিড-১৯ মহামারি। সেই দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার জন্য যে পরিমাণ অর্থনৈতিক প্রণোদনা সরকারের তরফ থেকে থাকা দরকার ছিল, অতটা ঠিক দেখা যায়নি।

সরকার যে ইচ্ছে করে ঐ কাজ করেছে, তাও নয়। সে নিজেও ছিল চাপে। বাড়তে থাকা ঋণের চাপ, সরকারি তহবিলের চাপ।

২০২৪ সালের শেষ নাগাদ চীনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এতটাই সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে যে, শি জিনপিংয়'র সরকার বহু প্রতীক্ষিত একটি প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করতে বাধ্য হয়। সেপ্টেম্বরে এই প্রণোদনার ঘোষণা আসার পর সবাই আশাবাদী হয়ে ওঠে। ব্যাংকের ঋণ প্রবাহ বাড়ানো হল, স্থানীয় সরকারগুলোকে লোন রিশিডিউল করার সুযোগ দেয়া হল, সহজ করে দেয়া হল বাড়ি কেনার লোন। এতে ফলাফল এসেছে ঠিকই, কিন্তু বাড়েনি ভোগ্য ব্যয়, consumption cost।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-ও সতর্ক করেছিল যে, এই প্রণোদনা চীনে মূল্যহ্রাস (deflation) ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

২০২৪ সালের শেষ দিকে সরকারি সূত্রে জানানো হয় যে, প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত করতে কেন্দ্রীয় সরকার ২০২৫ সালে ৩ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (৪১১ বিলিয়ন ডলার) মূল্যের বিশেষ বন্ড (sovereign bonds) ইস্যু করবে। তবে এই তহবিল কীভাবে ব্যয় করা হবে, সে সম্পর্কে খুব বেশি বিশদ তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।



ব্যয় সংকট

বিশ্ব অর্থনীতি যদি রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতি নেয়, তাহলে হুট করে কমে যায় রপ্তানি আয়।

১৯৯০-এর দশকের শেষ থেকে চীনের অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে আসছিলেন।

তারা বলছিলেন, আমরা কেবল উৎপাদন বাড়াচ্ছি আর রপ্তানি করছি। কিন্তু সাধারণ মানুষের খরচের সুযোগ সবসময়ই থাকছে সীমিত। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও এর সাথে একমত হয়ে বলেছিলেন- চীনের অর্থনীতি "অসামঞ্জস্যপূর্ণ, অপরিকল্পিত এবং অস্থিতিশীল"।

রপ্তানি বাড়লে যদি দেশের আয় বাড়ে, সেটা তো আর খারাপ না। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতি যদি রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতি নেয়, তাহলে হুট করে কমে যায় রপ্তানি আয়।

এদিকে স্টিল, গাড়ি ও কয়লা খাত অতিরিক্ত উৎপাদনের চাপে পড়েছে। পণ্যের দাম কমে গেছে, কমছে মুনাফা। এদিকে দেশের মানুষের খরচের সুযোগ তৈরি না হলে অভ্যন্তরীণ বাজারই বা কিভাবে তৈরি হবে! সেই জন্য তো আমদানিও চাই!

২০০৯-১০ সালে সরকার এই ভুলটাই করেছিল। প্রণোদনা চালু করেছে, কিন্তু তার সুফল পেয়েছে স্থানীয় সরকার ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। স্টিল কারখানা, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আবাসন খাতে এর ফলে আরও বেশি উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হয়। তাতে সংকট যায় আরও বেড়ে।

জনগণের হাতে নগদ টাকা আর পৌঁছায়নি। চীন নীতিগতভাবেই এই পদ্ধতির বিরোধী ছিল।



শ্রমবাজারের সংকট

জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ও তাইওয়ান সবই ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল।

চীনের অর্থনীতি নানা কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ আছে। শ্রমশক্তির সংকট এগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।

চীনের বিশাল গ্রামীণ জনসংখ্যা ছিল প্রায় সীমাহীন শ্রমশক্তির উৎস। রাষ্ট্রীয় কঠোর শাসন আর স্বাধীন শ্রমিক ইউনিয়ন না থাকায় শ্রমিকদের মজুরি বা অন্যান্য ন্যায্য দাবি আদায়ের কোন সুযোগ ছিল না। এর ফলে অন্যান্য এশীয় দেশগুলোর তুলনায়, দীর্ঘ সময় ধরে, চীন কম মজুরি দেয়ার সুবিধা পেয়েছিল।

১৯৯৪ সালে চীন সরকার গ্রামীণ এলাকা থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করায় বাধাগ্রস্ত হয় কৃষি এবং শিল্পকেন্দ্রিক উন্নয়ন। মানুষ কাজের খোঁজে গ্রাম ছেড়ে ভিড় জমায় শহরগুলোতে। আপেক্ষাকৃত সহজে কাজ খুঁজে পেয়েছিল রপ্তানি-ভিত্তিক শিল্প খাতে। কিন্তু ২০১০ সালের মধ্যে তরুণ শ্রমিকদের যোগান কমে আসে। অভিজ্ঞ শ্রমিকরা আর কম মজুরিতে কাজ করতে রাজি হচ্ছিল না।

অন্যান্য এশীয় রপ্তানি-ভিত্তিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জন্মহার কমেছে। ফলে, কর্মক্ষম জনগণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার তুলনায় কমে গেছে। এর ফলে গ্রামীণ জনসংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে এবং উৎপাদন খাতে মজুরি বাড়তে শুরু করে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ও তাইওয়ান সবই ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল।

তবে চীন অন্য দেশের তুলনায় একটু তাড়াতাড়ি এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। কারণ, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির এক-শিশু নীতি। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে বৃদ্ধদের সংখ্যা বাড়ার কারণে চীনের জনসংখ্যা অনেক আগেই বার্ধক্যে পৌঁছে যায়।

তারুণ্য নির্ভর শ্রমশক্তি কমে আসছে অথচ শিল্পে উন্নয়ন ও উৎপাদন এগুছে বেশ ধীর গতিতে। যদিও সরকারী হিসেব দেখাচ্ছে, রপ্তানি পণ্যের হার সন্তোষজনক, আদতে তা নয়।

২০১০ থেকে চীন সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে উৎপাদনে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়ানোর ওপর। কিন্তু এখনো পর্যন্ত চীন assemble এর কাজই বেশি করে। যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তি সবই আসে বাইরে থেকে। যেমন- আইফোন, হুয়াওয়ের ৫জি বেস স্টেশন কিংবা সি৯১৯ বিমান- কোন কিছু চীন নিজস্ব যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে তৈরি করে না।

এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে চায় সরকার। তাই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে বিনিয়োগ করেছে প্রচুর সম্পদ। এর ফলে এসেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য।

উন্নত লিথিয়াম ব্যাটারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে চীন এগিয়ে গেছে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির কাজে। তবে সাফল্যের তুলনায় বিনিয়োগ অনেক বেশি হয়ে গেছে বলে, পাল্টা সমালোচনাও আছে।



সামাজিক নিরাপত্তায় দুর্বলতা

চীনা পরিবারগুলো এখন অবসর জীবনে পুরোপুরি নিজস্ব সঞ্চয়ের উপর নির্ভরশীল।

সাধারণত একটি দেশ যখন অর্থনৈতিক অগ্রগতির রাস্তায় ভালভাবে থাকে, তখন তার জনগণের সামাজিক সুরক্ষার জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ নিশ্চিত করে রাখে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত হয়, শিক্ষা ব্যবস্থা মজবুত হয়। ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা না থাকায় মানুষ তখন টাকা জমিয়ে না রেখে খরচ করে। ফলে গতিশীল থাকে অর্থনীতি। চীন এই ক্ষেত্রে খুব বেশি সাফল্য দেখেনি।

বাজার সংস্কার করতে গিয়ে দেশটি ভেঙে দিয়েছিল জনগণের কমিউন আর শহরের কাজের ইউনিট। বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, পেনশন এবং অন্যান্য পাবলিক সেবা নিশ্চিত করার আর কোন বিকল্প ব্যবস্থাই সে তৈরি করল না। তিন দশকের সংস্কারে ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ।

চীনা পরিবারগুলো এখন অবসর জীবনে পুরোপুরি নিজস্ব সঞ্চয়ের উপর নির্ভরশীল। এর ফলে, চীনা পরিবারের খরচের হার কমে গেছে।

অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী না হলে চীনের অর্থনীতিকে আরও বেশি রপ্তানি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে।



জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসিওলজি বিভাগ এর অধ্যাপক হো-ফাং হুং চীনের অর্থনীতি আর রাজনীতির উপর নজর রাখেন নিয়মিত। বেশ কিছু বই লিখেছে তিনি। এগুলোর মধ্যে আছে- "The China Boom" (২০১৫), "Clash of Empires: From 'Chimerica' to the 'New Cold War'" (২০২২), এবং "The China Question: Eight Centuries of Fantasy and Fear"।

এই হো-ফাং হুং, চীনে অর্থনৈতিক গতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে হলে, যেগুলো করা দরকার বলে মনে করেন- শ্রমিক শ্রেণীকে শক্তিশালী করা, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা তৈরি করে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির অধিকার রক্ষা করা, আর্থিক ব্যবস্থার উদারীকরণ করা - ইত্যাদি। কিন্তু তিনি সাবধান করে দেন- এই সব সংস্কার পার্টি-রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষুন্ন করার ঝুঁকি তৈরি করে। তাই এই পথে হয়ত হাঁটতে চাইবে না কমিউনিস্ট পার্টি।

পড়ে দেখতে পারেন