অভিবাসীদের কিভাবে দেখা উচিত আমাদের?
মানুষ ছুটছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে।
যাচ্ছে ইউরোপ; যাচ্ছে আমেরিকা, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায়, বা অন্য কোন প্রতিবেশী দেশে।
যাচ্ছে আফ্রিকা, এশিয়া কিংবা লাতিন আমেরিকা ছেড়ে। কখনো বাধ্য হয়ে, কখনো বা স্বেচ্ছায়।
কারণ যাই হোক না কেন, একবিংশ শতাব্দীতে অভিবাসন একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩%, প্রায় ২৮৪ মিলিয়ন মানুষই আন্তর্জাতিক অভিবাসী!
অভিবাসী মানুষ সাধ করে হয় না। নিজের জীবন বাঁচাতে বা উন্নত জীবনের সন্ধানে সে দেশান্তরী হয়।
যুদ্ধ বিগ্রহ, জাতিগত সংঘাত লক্ষ লক্ষ মানুষকে উদ্বাস্তু করে দিলে, তাদের বাঁচার জন্যই নতুন ঠিকানা খুঁজতে হয়। স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়ে অভিবাসী হওয়ার প্রবণতা কিন্তু বেড়েছে মাত্র বছর ত্রিশেক আগে- ১৯৯০ এর দশক থেকে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে যেন একটা লোহার দরজা খুলে গেল। সেই দেশ, সাথে পূর্ব ইউরোপের মানুষ পাগল হয়ে ছুটতে শুরু করল পশ্চিমে। সেই সময়ই দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে পাসপোর্ট প্রক্রিয়া সহজ হয়ে আসে। তারাও শুরু করল অন্য জীবনের খোঁজ। সতর্ক হয়ে উঠল পশ্চিমা এবং বড় দেশগুলো; তাদের ভিসা নীতি হয়ে উঠল কঠোর।
আর এদিকে শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ কোটিতে।
এদের মধ্যে প্রায় ৫ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত। এছাড়াও রাষ্ট্রহীন (stateless) জনগোষ্ঠীও রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ। মোট অভিবাসীদের প্রায় অর্ধেকই আবার নারী। পাশাপাশি এমন উদাহরণও আছে, পরিবার ছেড়ে শিশুরা চলেছে অভিবাসী হতে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো, গ্লোবাল সাউথে (১৪ কোটি) অভিবাসনের প্রবাহ গ্লোবাল নর্থের (১৪ কোটি) সমান হয়ে গেছে। এর মধ্যে দক্ষিণ থেকে উত্তরে (পরিবার, শ্রমিক, শরণার্থী, শিক্ষার্থী) এবং উত্তর থেকে উত্তরে (দক্ষ জনবল, শিক্ষার্থী, পর্যটক) অভিবাসন যেমন আছে, তেমনি উত্তর থেকে দক্ষিণে (উদ্যোক্তা, অবসরপ্রাপ্ত নাগরিক, নতুন বাজার অনুসন্ধানী দক্ষ কর্মী) এবং দক্ষিণ থেকে দক্ষিণে (উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিক, শরণার্থী, জলবায়ু উদ্বাস্তু) অভিবাসনের প্রবাহও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
অভিবাসনের ধরনগুলো ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠছে, কারণ অনেক শরণার্থী বা পারিবারিক পুনর্মিলনের খোঁজে আসা অভিবাসী কর্মসংস্থানও খুঁজছে। অতীতে রাজনৈতিক শরণার্থী ও সাধারণ শ্রমিকদের আলাদা করা সহজ ছিল, কিন্তু এখন অভিবাসীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সাধারণত গড় জনসংখ্যার চেয়ে বেশি, এবং তারা নিজ দেশে থাকার তুলনায় গন্তব্য দেশে তিনগুণ বেশি উৎপাদনশীল।
১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ কম দক্ষ শ্রমিকদের অভিবাসনের সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণকে কঠোর করেছে। ফলে, অভিবাসনের প্রবাহ আরও জটিল হয়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে, শরণার্থী মর্যাদার আবেদন করাই বৈধভাবে দেশে থাকার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ৩০ বছরে অভিবাসনের ক্ষেত্রে দুটি মূল প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে—একদিকে চলাচলের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে কঠোর অভিবাসন নীতির প্রসার। জনসংখ্যাগত পরিবর্তনও এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। যেমন, আফ্রিকার নগরায়ন ১৯৫০ সালে ৩০% থেকে ২০৫০ সালে ৭০%-এ পৌঁছানোর পূর্বাভাস রয়েছে। গ্লোবাল নর্থের (যেখানে গড় বয়স ৪০) এবং গ্লোবাল সাউথের (যেমন, সাব-সাহারান আফ্রিকায় গড় বয়স ১৯) মধ্যে বয়সের পার্থক্যও অভিবাসনের গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করছে।
বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশ এখন সীমান্ত সুরক্ষাকে অভিবাসন নীতির প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে, যদিও শ্রম ঘাটতি পূরণ ও অর্থনীতির প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে অভিবাসন প্রয়োজন। ফলে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উদারনীতির প্রয়োজনীয়তা এবং জাতীয় নিরাপত্তা-ভিত্তিক নীতির মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।
সীমান্ত কঠোর করার ফলে অভিবাসীরা দুটি পথের মুখোমুখি হচ্ছে—"প্রধান দরজা" বা "পেছনের দরজা"। যেমন, জোলবার্গ (১৯৭৮) বলেন, "অনিয়মিত অভিবাসীরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের ভণ্ডামির শিকার।"
প্রতিটি দেশ নিজস্ব প্রবেশ নীতি নির্ধারণ করায় বৈশ্বিক পর্যায়ে চলাচলের অধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে। জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের ঘোষণাপত্র, ১৯৫১ সালের জেনেভা কনভেনশন এবং ১৯৯০ সালের অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশন সত্ত্বেও বাস্তবে দেশগুলো সীমান্ত প্রবেশ কঠিন করে তুলেছে।
ফলে, অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গ্লোবাল নর্থ থেকে সাউথে অভিবাসন সহজ, কিন্তু অভিবাসীদের অধিকার সীমিত থাকে। গ্লোবাল নর্থের অভ্যন্তরে অভিবাসন তুলনামূলক সহজ এবং অধিকারের নিশ্চয়তা বেশি। কিন্তু দক্ষিণ থেকে উত্তরে অভিবাসন কঠিন হয়ে উঠেছে, যার ফলে ভূমধ্যসাগর ও মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তে প্রচুর প্রাণহানি ঘটছে।
উন্নত দেশগুলো অভিবাসন নীতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করলেও, তারা জাতিসংঘের ১৯৯০ সালের অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ কনভেনশন ratify করেনি। অভিবাসন নীতির ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো তাদের স্বার্থের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়মিত অভিবাসন, শরণার্থী সংকট, আটক শিবির এবং সীমান্তে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে।




