সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ঃ ইসলাম থেকে বিচ্যুতি?

Asad_USA
২০১৬ সালে ঘোষিত সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনা ইসলামের মূলধারা থেকে বিচ্যুত হচ্ছে না কি সময়ের সাথে খাপ খাওয়াতে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করছে!

'একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব।

নারীরা এখন গাড়ি ড্রাইভ করতে পারছে, তৈরি হচ্ছে সিনেমা হল, গড়ে উঠছে রিসোর্ট, আসছে মার্কিন সঙ্গীত তারকারা কন্সার্ট করতে!

সৌদি ভিশন ২০৩০ চাইছে সেই পুরনো তেলের ব্যবসার উপর অতি-নির্ভরতা কমিয়ে আনতে। পরিবর্তে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে প্রযুক্তিতে, বাড়াচ্ছে পর্যটনে।

সৌদি এই উদ্যোগ নাড়া ফেলেছে সারা বিশ্বে। তার এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে আইএস আর আল কায়েদা।

দেশের ভিতরে এই সংস্কারের বিরুদ্ধে যারাই কন্ঠ তুলেছে, তাদেরই শক্তভাবে দমন করেছে সরকার। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুরআন বিজ্ঞান অনুষদের প্রাক্তন ডিন, আহমাদ আল-আমারি, সংস্কারের সমালোচনা করার কারণে ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হন; কারাগারেই মারা যান তিনি।

ইসাম আল-উবাইদ নামের একজন ইমামকে ২০১৭ সালে দেয়া হয় চার বছরের কারাদণ্ড।

সবাইকে আরও হতভম্ব করে দিয়ে ২০২৩ সালে ক্রাউন প্রিন্স সালমান সাহেব প্রকল্প নিলেন- হাদিস সংস্কার!

কিন্তু কেন নেয়া হচ্ছে এতসব পদক্ষেপ? এটা কি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন? না কি পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ক্রাউন প্রিন্সের নিতান্তই ব্যক্তিগত মর্জি?



ওয়াহাবি

স্মরণ করা দরকার, ওয়াহাবি রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ইতিহাস সালমান সাহেবের এই রাজ পরিবারের আছে।

আঠারশ' শতাব্দীর শেষের দিকে মুহম্মদ ইবন আবদ-আল-ওয়াহাব প্রতিষ্ঠা করেন ওয়াহাবীবাদ।

ওয়াহাব সাহেব নিজে অবশ্য কখনো 'ওয়াহাবী' শব্দ ব্যবহার করেননি। তারা নিজেদের বলতেন 'মুজাহিদুন' বা ঐক্যপন্থী। তাদের লক্ষ্য ছিল, সমাজের নৈতিক সংস্কার; কায়েম করতে চেয়েছিলেন 'বিশুদ্ধ ইসলাম'।

সেই সময়ের আরব ছিল রাজনৈতিকভাবে খণ্ডিত; গোত্রে গোত্রে বিভক্ত। শক্তিশালী ধর্মীয় নির্দেশনার অভাব ছিল প্রবল। তাই আবদ-আল-ওয়াহাব নিজেদের 'ঐক্যপন্থী' বলতেন। 'বিশুদ্ধ ইসলাম' দিয়ে তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন আরব'কে।

তিনি কঠোরভাবে বলে দেন- শুধু কলেমা পড়লেই মুসলমান হওয়া যাবে না। সঠিকভাবে উপাসনা করতে না জানলে, সে আর কোনমতেই মুসলমান থাকে না; কাফেরের পর্যায়ে নেমে যায়। বলাই বাহুল্য, তাদের সমালোচনার সবচেয়ে বড় শিকার ছিল সেই সময়ের শক্তিশালী সুফিবাদী ধারা।



ওয়াহাবি আর সৌদ

১৫০ বছর ধরে সৌদি বংশ অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়েছে

আজকের যে সৌদি রাজবংশ, এর শুরুটা আঠারো শতাব্দীতে।

রিয়াদ'র কাছেই ছোট শহর আদ'দিরিয়াহ। সেই শহরের গোত্র প্রধান মুহম্মদ ইবন সৌদ জোট বাঁধলেন ধর্মীয় নেতা মুহম্মদ ইবন আবদ-আল-ওয়াহাব'র সাথে। এই আল-ওয়াহাব-ই হলেন ইসলামের ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।

আদর্শিক ভিত্তিতে তৈরি হওয়া এই জোটের মধ্যেই ছিল সৌদি সাম্রাজ্য বিস্তারের ভ্রূণ।

এরপর প্রায় ১৫০ বছর ধরে সৌদি বংশ অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়েছে। কখনো ক্ষমতায় গেছে, কখনো দীর্ঘদিনের জন্য নির্বাসিত হয়েছে।

বিংশ শতাব্দী তাদের জন্য নিয়ে আসে এক নতুন সুযোগ।

১৯০২ সাল থেকে ক্ষমতা পাকাপাকিভাবে দখলে মরীয়া চেষ্টা চালায় সৌদ'রা। সেই সময় তাদের নেতা ছিল আব্দুল্লাহ আজিজ আল সৌদ। পুরনো মিত্র ওয়াহাবিপন্থী বেদুইন গোত্রগুলোকে সৈন্যবাহিনীতে পেয়ে শক্তি বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল তার।

এর মধ্যে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল, অটোমানরা পরাজিত হল; আর ব্রিটিশদের নেক নজরের পুরোটাই আদায় করে নিলেন আব্দুল্লাহ আজিজ আল সৌদ।

সেই সময়ে সবচেয়ে বড় রাজ্য হেজাজ যখন দখলে এল তার, ১৯২৭ সালে, বেদুইনরা সেখানে থামতে চাইল না। তারা চাইল বৃটিশ অধীনস্থ জর্ডান, ইরাক আর কুয়েতে হামলা চালাতে। কিন্তু বৃটিশদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়াতে রাজি হলেন না আব্দুল আজিজ। এতদিনের মিত্র ওয়াহাবিপন্থী বেদুইনরা বিদ্রোহী হয়ে উঠল। ১৯২৯ সালের যুদ্ধে তাদের নির্মমভাবে দমন করলেন তিনি।

১৯৩২ সালে দুটো রাজ্য- হেজাজ আর নাজদ- এক করে তৈরি হল 'কিংডম অফ সৌদি আরব'।



তেলের শক্তি

সৌদি রাজ আবার বেকায়দায় পড়ল ইরাক যুদ্ধের সময়ে, ১৯৯১ সালে

রাজনৈতিক ক্ষমতা তো পাকাপোক্ত হয়েছিল, কিন্তু অর্থনীতিতে খুব একটা সুববিধা করতে পারছিল না সৌদি আরব।

১৯৩৮ সালে আল-হাসা'তে তেলের খনির আবিষ্কার সৌদি আরবের ইতিহাস নতুন করে লিখতে শুরু করল। তেলের গন্ধে ছুটে এল নতুন শক্তিধর দেশ- আমেরিকা।

১৯৪৫ সালে আব্দুল আজিজ আর প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট করলেন এক মৌখিক চুক্তি। সৌদি আরব'কে আমেরিকা দিবে সামরিক প্রতিরক্ষা আর বিনিময়ে সে নিবে তেল। এই সময় থেকে সৌদি আরবে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলানোর জন্য নানা রকম অর্থনৈতিক সংস্কার হাতে নেয়া হয়। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন ছড়াতে থাকে; রাস্তায় বাড়ে গাড়ির সংখ্যা। শিল্প কারখানায় নিয়োগ দেয়া হয় বিদেশী বিধর্মী বিশেষজ্ঞদের। এই উদ্যোগ একদমই পছন্দ করেনি কট্টর ওয়াহাবিপন্থীরা।

১৯৭৯ সালে ইরানে শিয়া সমর্থিত শক্তি যখন ক্ষমতায় চলে এসে দারুণ মাথাব্যথার কারণ দিল ওয়াহাবি প্রাধান্যের সৌদি আরব'কে। অভ্যন্তরীণ যে কোন বিপদ মোকাবেলায় সরকারকে তখন কিছুটা সমঝে চলতে হয়েছে কট্টর ধারাকে; সে ওয়াহাবিবাদের প্রতি তার নিঃশর্ত আনুগত্যের কথা আবার জানান দিতে শুরু করল। উলেমাদের হাতে দিল আরও ক্ষমতা।

সৌদি রাজ আবার বেকায়দায় পড়ল ইরাক যুদ্ধের সময়ে, ১৯৯১ সালে।

ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে এই সৌদি আরবেই ঘাঁটি গাড়ল আমেরিকা। রাজতন্ত্রের এহেন ভূমিকায় আহত হয়ে গড়ে ওঠা 'ইসলামিস্ট অপজিশন' এর নেতা সালমান আল-ঔদা এবং সাফার আল-হাওয়ালি'র মত জনপ্রিয় ইমামেরা সরকারের কঠোর সমালোচক হয়ে উঠলেন। সরকারও সব সমালোচনার জবাব দিল কঠোরতর দমন পীড়নের মাধ্যমে।



নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থার সময়ে সৌদি আরব

সৌদি আরবের এখন দরকার প্রচুর বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করা

ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় পেরিয়ে এসে সৌদি আরব'কে মোকাবিলা করতে হচ্ছে এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা।

আমেরিকার সাথে এখনো সখ্যতার কমতি হয়নি, কিন্তু সামরিক দিক থেকে আর তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে রাজি নয় সে। সম্পর্ক বাড়ছে চীনের সাথে, বিশেষ করে তেল রপ্তানিকে কেন্দ্র করে; বিনিময়ে চীন তার সেই বিখ্যাত 'বেল্টস আন্দ রোডস ইনিশিয়েটিভ' নিয়ে হাজির এখানে। ওপেক প্লাসে রাশিয়াও এখন তার সহযোদ্ধা। ইন্ডিয়া, জার্মানিসহ আরও নানা দেশের সাথে সম্পর্ক বাড়িয়ে তার নেটওয়ার্ক ছড়াতে চাইছে সৌদি আরব।

কারণ সে বুঝে গেছে, সামনে আসছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির যুগ। শুধু তেলের উপর নির্ভর করে থাকা অর্থনীতি পড়বে গভীর চ্যালেঞ্জের মধ্যে। তাই নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে সব কিছু। আর সেই জন্যই এসেছে 'ভিশন ২০৩০'।

সৌদি আরবের এখন দরকার প্রচুর বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করা- প্রযুক্তিতে, শিল্পে বা বাণিজ্যে। আর বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে তাকে দেখাতে হবে- আমাদের সমাজকে যেমন ভাবছ, আমরা আর তেমন নেই। আমরা নারী স্বাধীনতার কথা বলি, আমরা কথায় কথায় আসামীকে কতল করি না বা আধুনিক প্রযুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই না।

তাই প্রিন্স সালমান'র উদ্যোগের সাথে তার ব্যক্তিগত শিক্ষা বা ধর্ম সংস্কারের চেষ্টার কোন সম্পর্ক নেই। পুরোটাই অর্থনৈতিক পদক্ষেপ।



চ্যালেঞ্জগুলো

সৌদি সরকারের বর্তমান উদ্যোগগুলোকে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগুতে হবে-

  • তেলহীন অর্থনীতি
  • যতই আকাঙ্ক্ষার কথা বলুক, দেশটি এখনও তেল রাজস্বের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এর বিকল্প গড়ে তোলা দীর্ঘমেয়াদী আর জটিল কাজ।

  • মেগা-প্রকল্পের কার্যকারিতা
  • উচ্চাভিলাষী যে গিগাপ্রকল্পগুলো হাতে নিয়েছে (যেমন নিওম) সেগুলো আর্থিক, লজিস্টিক এবং প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জে পড়ে গেছে।

  • দক্ষ কর্মীবাহিনী
  • ভিশন ২০৩০-এর লক্ষ্য অর্জন করতে যে মেধাবী আর দক্ষ কর্মীবাহিনীকে টানা দরকার- রক্ষণশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সেটা কঠিন হতে পারে।

  • ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি
  • ইজরাইলের আগ্রাসন, ইরানের হুমকি বা ইয়েমেনে অস্থিরতা - সব কিছু প্রভাবিত করতে পারে তার মসৃণ যাত্রাকে। সেই সাথে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সম্ভাবনা তো থাকছেই।

  • মানবাধিকার
  • সৌদি আরবের মানবাধিকার রেকর্ডের সমালোচনা বিদেশী বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্বকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।

  • গতি
  • দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের প্রাথমিক গতি বজায় রাখা এবং সকল ক্ষেত্রে কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হবে।



ভিশন ২০৩০ তার সব উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জন করে ফেলবে, এমন সম্ভাবনা কম। তবে, এটা নিশ্চিত যে- এই কর্মসূচি সৌদি অর্থনীতি ও সমাজে উল্লেখযোগ্য এবং দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনবে। এই কর্মসূচি ইতোমধ্যেই পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। অর্থনীতিকে বহুমুখী করা ও দেশকে আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে কিছু সাফল্যও সৌদি আরব দেখাতে পেরেছে।

পড়ে দেখতে পারেন