এশিয়ার 'বাঘ' দক্ষিণ কোরিয়ার কি হাল ?

৫০ বছর আগেও দেশটি ছিল এশিয়ার দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি।
আর এক মানবজন্মের সময়কালেই দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকরা উন্নত দেশের স্ট্যান্ডার্ডে জীবন যাপন করতে পারছে! বিশ্বের ধনী অর্থনীতির তালিকায় এখন তার অবস্থান থাকে প্রথম ১০-১৫ এর মধ্যে! তার অর্থনীতি এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের যা কোন দেশ এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশের তুলনায় অনেক শক্তিশালী!
কি করে সম্ভব হল এটা?
প্রথমেই জেনে রাখা দরকার, এই 'বাঘ' উপাধি দিয়েছিল কারা এবং কেন? দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফ। এশিয়ার বাকি তিন 'বাঘ' ছিল- তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর আর হংকং। ১৯৯৩ সালে বিশ্বব্যাংক তার এক রিপোর্টে দাবি করেছে, এইসব দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ছিল তাদের প্রেস্ক্রাইব করা 'নিও লিবারেল' ইকোনমির ফলাফল।
কিন্তু যে গতিতে ৯০ এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়ার শনৈ শনৈ উন্নতি হয়েছিল, সেটা কি এখনো বিদ্যমান? না, একইভাবে না। আইএমএফ'র আদরের 'বাঘ' এখন ঠিক আগের মত অতটা শক্তিশালী নয়। তার বিশাল উন্নতি, মাথা তুলে দাঁড়ানো, পিছিয়ে পড়া- এই সব কিছুই উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি চমকপ্রদ কেইস স্টাডি।
বিধ্বস্ত কোরিয়ার মার্কিন নির্ভর হয়ে ওঠার কাল

১৯৫৩ থেকে ৬০- এই সাত বছর দেশটি পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ল মার্কিনীদের উপরে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ কোরিয়া ছিল জাপানের উপনিবেশ। যুদ্ধে জাপান হেরে যাওয়ায়, মিত্র শক্তি দায়িত্ব নিল দেশের।
আগস্ট ১৯৪৫ এ আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসের অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলোর একটি ঘটল। কোরিয়ান মানুষের কথা চিন্তা না করেই, আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠিক করে দিল- আপাতত দেশটাকে দুই ভাগে ভাগ করা হবে। উত্তর দিকটা শাসন করবে সোভিয়েতরা, আর দক্ষিণ দিকটা আমেরিকা।
কথা ছিল, এই ব্যবস্থাটা হবে সাময়িক!
কিন্তু কোন ঐকমত্যে পৌঁছানো গেল না। ১৯৪৮ সালে দুই অংশে গঠিত হল দুই সরকার।
২৫ জুন ১৯৫০ এ উত্তর কোরিয়া হামলা করে বসল দক্ষিণ কোরিয়ায়; লক্ষ্য- দুই কোরিয়া'কে এক করে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কয়েকদিনের মধ্যেই দখল হয়ে গেল সিউল। জাতিসঙ্ঘকে যুক্ত করে পাল্টা হামলা চালাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উত্তর কোরিয়ার বাহিনীকে তাড়া করে নিয়ে গেল চীন সীমানার কাছাকাছি। যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে চীন'ও।
১৯৫৩ তে এসে অস্ত্রবিরতি হল। কিন্তু ততদিনে একদম বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। ২৫ লাখ সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে, বোমা পড়ে শহরগুলো সমান হয়ে গেছে, শিল্প কারখানা সব ধ্বংস; মাথাপিছু আয় নেমে দাঁড়ায় মাত্র ৬৭ ডলারে। দক্ষিণ কোরিয়া'কে সেই সময় বিবেচনা করা হত বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে।
১৯৫৩ থেকে ৬০- এই সাত বছর দেশটি পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ল মার্কিনীদের উপরে। আমেরিকা খাবার দিল, পুঁজি দিল, কল কারখানার যন্ত্র দিল; যোগান দিল দেশের বাজেটের ৭০ ভাগ পর্যন্ত!
স্বৈরতন্ত্রের কাল

১৯৫৪ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি বৃদ্ধি পায় বছরে গড়ে ৪.৯% হারে।
১৯৪৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্ষমতায় বসেছিলেন সিংমেন রি।
আমেরিকায় পড়াশোনা করা উচ্চশিক্ষিত রি হাল ধরতে চেয়েছিলেন বিধ্বস্ত অর্থনীতির; কিন্তু ধীরে ধীরে আবির্ভূত হলেন স্বৈরাশাসক হিসেবে। একের পর এক কারচুপির নির্বাচন, কঠোর মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ আর বিরোধী দলের ওপর দমন পীড়ন চালিয়ে ক্ষমতায় থাকলেন বারো বছর!
মার্চ ১৯৬০ এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও তিনি দাবি করেছিলেন ৯০% ভোট পাওয়ার। কিন্তু নির্বাচনে কি পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, সেটা সাদা চোখেই দেখতে পেয়েছিল জনগণ। রাস্তায় নেমে এল ছাত্র জনতা। বিক্ষোভ দমন করতে গুলি চালিয়ে শ' খানেক মানুষকে হত্যা করল রি। কিন্তু বিক্ষোভ দ্বিগুণ হল! ফলে এপ্রিলের ২৬ তারিখে পদত্যাগ করে রি পালাল হাওয়াই'তে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় চালু হল সংসদীয় ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী হলেন চ্যাং মিয়ন।
১৯৪৫ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে ৩.১ বিলিয়ন ডলারের বিশাল সহায়তা প্রদান করে। এই অর্থ যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো পুনর্গঠন ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যয় করা হয়।
দেশটির অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল তিনটি প্রধান পণ্য - ময়দা, চিনি ও তুলা। এগুলোর উৎপাদনের উপর জোর দেয়া হয় বিশেষভাবে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি বৃদ্ধি পায় বছরে গড়ে ৪.৯% হারে।
সামরিক শাসনের কাল

১৯৮৭ এর জুন মাসের গনঅভ্যুত্থানে রাস্তায় নেমে এল লাখ লাখ মানুষ। বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করল জেনারেল চুন।
কিন্তু চ্যাং মিয়ন'র শাসন ছিল দুর্বল আর অদক্ষ।
দেশে বিভক্তি বাড়তে শুরু করেছিল আরও দ্রুত, বাড়ছিল দুর্নীতি। অন্তর্কোন্দলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল জনগণ। এই অবস্থা চললে কি, যে কোনদিন কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়া কি আবার আক্রমণ করে দখল করে নিবে দক্ষিণকে? মার্কিনীরা হিসেব করেই সমর্থন দিল সামরিক অভ্যুত্থানকে। ১৯৬১ এর মে মাসে জেনারেল পার্ক চুং-হি দখল করল ক্ষমতা। জারি হল মার্শাল ল; গঠিত হল 'সুপ্রিম কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল রিকন্সট্রাকশন'।
পার্ক চুং হি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গণতন্ত্রের। কিন্তু ক্ষমতা ধরে রাখলেন ১৮ বছর! ১৯৭৯ সালে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিও চালালেন স্বৈরতন্ত্র।
অভিষেক ভাষণে পার্ক চুং-হি বললেন, "আমাদের শত্রু হলো দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও কমিউনিজম। আমি বিশ্বাস করি, এ তিনটি আমাদের সকলের সাধারণ শত্রু।"
ক্ষমতা দখলের পর, সামরিক সরকারের দরকার ছিল কিছু দৃশ্যমান ফলাফল। তাই তারা প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরে অনেক বড় করে - বার্ষিক ৭.১%। কিন্তু সেই অনুযায়ী দেশীয় ও বিদেশি পুঁজি সংগ্রহ করতে পারে না। ফলে, ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিকল্পনা সাজাতে হয় ভিন্নভাবে।
রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ স্পষ্ট ছিল, তবে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। শিল্পায়ন আর রপ্তানি বাড়াতে নেয়া হয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। গুরুত্ব দেয়া হয় টেক্সটাইল, স্টিল আর জাহাজ নির্মানের ওপর। রপ্তানিকে দেয়া হয় প্রধান অগ্রাধিকার।
এর ফলাফল আসে দ্রুত।
সস্তা শ্রমের উপর ভর করেই রপ্তানিমুখী শিল্প বিকশিত হতে থাকে দ্রুত গতিতে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে বছরে ৩০% থেকে ৪০% পর্যন্ত রপ্তানি বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৭ সালে রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০ বিলিয়ন ডলারে, আর ১৯৮৮ তে এটা পৌঁছে যায় ৬০ বিলিয়ন ডলারে।
এগুলোর সুফল মোটা দাগে আসলেও বাড়ছিল বৈষম্য, লঙ্ঘন হচ্ছিল শ্রম অধিকারের। তাই গড়ে উঠছিল ছাত্র জনতার আন্দোলন। অক্টোবর ১৯৭৯ সালে আন্দোলন চরম আকার নিল। অস্থিরতা বাড়ছিল সরকারের মধ্যে। তার প্রতিফলন দেখা গেল, ২৬ অক্টোবর।
ডিনার টেবিলে কথা বলছিল পার্ক দেশের অবস্থা নিয়ে। সেই টেবিলেই তাকে গুলি করে খুন করল কোরিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান কিম জে-গু; তার নিজের ভাষায় স্বৈরতন্ত্র শেষ করার জন্যই এক কাজ করেছে সে। এর পরের আট বছর এক ভয়ানক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে দেশ।
ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চই কিউ-হাহ প্রতিশ্রুতি দিলেন সংস্কারের কিন্তু নেপথ্যে ক্ষমতা থাকল জেনারেল চুন ডু-হুয়ান'র হাতে। মে ১৯৮০ তে এই জেনারেল ক্যু ঘটিয়ে মার্শাল ল জারি করে দিলেন। আবার শুরু ছাত্র জনতার আন্দোলন। প্রায় হাজারখানেক মানুষকে খুন করল জেনারেল চুন; ইতিহাসের কুখ্যাত গুয়ানঝু গণহত্যা ঘটাল সে।
১৯৮৭ এর জুন মাসের গনঅভ্যুত্থানে রাস্তায় নেমে এল লাখ লাখ মানুষ। বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করল জেনারেল চুন। ঐ বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হল, দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসের প্রথম অবাধ নির্বাচন।
গণতন্ত্রের কাল

এই সময়েই বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফ আদর করে দক্ষিণ কোরিয়া'কে নাম দেয় 'বাঘ'।
১৯৮৮ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়ী রোহ টায়-উ ছিল একজন সামরিক ব্যক্তি। কিন্তু ১৯৯২ সালে পরের নির্বাচনেই ৩০ বছরের মধ্যে প্রথম ক্ষমতায় এল একজন অসামরিক ব্যক্তি- কিম ইয়াং-স্যাম।
আপাত স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান উৎপাদন ও রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হয়; বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৭-৯%। এই সময়েই বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফ আদর করে দক্ষিণ কোরিয়া'কে নাম দেয় 'বাঘ'।
এই দশকে দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিকভাবে যে সব সাফল্য পেয়েছে, সেগুলো হল-
- জিডিপি'তে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭-৯% এ ধরে রাখা
- শ্রম-ঘন শিল্প থেকে প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পে প্রবেশ
- অটোমোবাইল, ইলেক্ট্রনিক্স আর সেমি কন্ডাক্টর পণ্য রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে এক নম্বর অবস্থানে পৌঁছে যাওয়া
- প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা
- যোগাযোগ ব্যবস্থার দারুণ উন্নতি ঘটানো
- জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা
- ১৯৯৬ সালে উন্নত দেশ হিসবে OECD-তে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়া
এরপর এল ১৯৯৭।
এশিয়ান অর্থনৈতিক সংকট

সংকট কাটাতে আইএমএফ'র দ্বারস্থ হল দেশটি; পেল ৫৮ বিলিয়ন ডলারের বেইলআউট প্যাকেজ।
১৯৯৭ এর সংকট দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য ছিল একটা বড় ধাক্কা।
সংকট শুরু হয়েছিল থাইল্যান্ড এর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে আসার ঘটনা থেকে। দ্রুত দেশের বাইরে চলে যেতে থাকে টাকা পয়সা আর সম্পদ, অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে- ক্যাপিটাল ফ্লাইট। এর ঢেউ গিয়ে লাগে পুরো এশিয়ায়। স্টক মার্কেটে দরপতন হতে থাকে, বাড়তে থাকে ঋণের পরিমাণ।
দক্ষিণ কোরিয়ায় ঝড় শুরু হতে দেরি হল না। তাদের মুদ্রা 'ওউন' মান হারাল ৫০% হারে। বিরাট কংগলোমেরেট 'ডাইয়ু' (Daewoo) বন্ধ হয়ে গেল। সংকট কাটাতে আইএমএফ'র দ্বারস্থ হল দেশটি; পেল ৫৮ বিলিয়ন ডলারের বেইলআউট প্যাকেজ। কিন্তু বিনিময়ে ঐ সংস্থার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অনেকগুলো পদক্ষেপ নিতেও বাধ্য হতে হল; যেমন- কঠোর অর্থনৈতিক সংস্কার, আর্থিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, কর্পোরেট ঋণ কমিয়ে আনা।
২০০০ সালের মধ্যে মোটামুটি সংকট কাটিয়ে নিজের অর্থনীতি গুছিয়ে নিতে পেরেছিল।
২০০০ এর দশক

২০০৮ এ আমেরিকার পুঁজিবাজারের সংকট পুরো পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
প্রথম দশকেই দেশটি ইলেকট্রনিক্স (স্যামসাং, এলজি), অটোমোবাইল (হুন্ডাই, কিয়া) এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বিশ্বে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। মন দেয় গবেষণায়; সেমি কন্ডাক্টর, মোবাইল ফোন আর অটোমোবাইলে অগ্রগতি ঘটায়। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে যোগ দেয়। সেই সাথে আমেরিকা আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে স্বাক্ষর করে ফ্রি টেড এগ্রিমেন্টে। এই সময়কালে বিশ্বের দশম শক্তিশালী অর্থনীতির তালিকায় স্থান পেয়ে যায় দক্ষিণ কোরিয়া।
তারপর এল ২০০৮।
২০০৮ এ আমেরিকার পুঁজিবাজারের সংকট পুরো পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। যেহেতু, দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানির একটা বড় অংশ যেত আমেরিকায়, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে বড় ধাক্কা এল। বিদেশী বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়ে যাওয়ায় স্টক মার্কেটে দরপতন হল প্রায় ৪০%। মুদ্রার দরপতন হল ৩০%; আমদানি খরচ বেড়ে গেল। এদিকে রপ্তানি গেল কমে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার এগিয়ে এল ২০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে। সুদের হার কমিয়ে ঋণ আর বিনিয়োগে উৎসাহ যোগাল। ক্ষুদ্র আর মাঝারি শিল্পের জন্য দিল আর্থিক সহযোগিতা। ২০১০ এর মধ্যে ফলাফল ভালই এল।
চীনে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আর আমেরিকা-ইউরোপের অর্থনীতি একটু থিতু হওয়ার কারণেই ২০১০ এ আবার দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানি বৃদ্ধি পেল ২৭.৩%। জিডিপি বৃদ্ধির হার আবার ফিরল ৬.৫% এ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভাল হওয়ার দরুন ব্যাংকিং সেক্টরও থাকল স্থিতিশীল হয়ে।
২০১০ এবং তারপর

আরেকটা অদ্ভুত সমস্যা আছে দক্ষিণ কোরিয়ার। এখানে জন্মহার বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন।
এই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠে। সেমিকন্ডাক্টর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবটিক্স এবং বায়োটেকনোলজিতে পরিণত হয় বিশ্বশক্তিতে।
কিন্তু এর মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পড়ে যায় চ্যালেঞ্জে।
ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ভয়ংকর হারে। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধের হারও গেছে কমে। আরেকটা অদ্ভুত সমস্যা আছে দক্ষিণ কোরিয়ার। এখানে জন্মহার বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন। জনসংখ্যার অধিকাংশ হয়ে গেছে প্রবীন। এর প্রভাব পড়ে উৎপাদনশীলতায়।
এর মধ্যে তিনটি বড় আন্তর্জাতিক ঘটনা রপ্তানি-নির্ভর দেশটিকে পিছিয়ে দিয়েছে-
- ২০১৮ তে আমেরিকা-চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি
- ২০২০ এ কোভিড ১৯ এর কারণে বড় আকারে কমেছে রপ্তানি
- ২০২২ এ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়াটাও চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য
২০২২ এ মূল্যস্ফীতি সামলাতে সুদের হার বাড়াতে হয় তাকে। ফলে রিয়েল এস্টেট, বিনিয়োগ বা কনজিউমার খরচ কমে গেছে অনেক। এর মধ্যে শিক্ষিত বেকারদের জন্য কাজের সুযোগ কমে গেছে, ফ্যাক্টরিতে এআই বা অটোমেশন এসে কাজ কেড়ে নিচ্ছে মানুষের। ফলে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা। এদিকে শিল্পে চীনের অগ্রগতি আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক ক্ষেত্রেই কমিয়েছে কোরিয়ান পণ্যের চাহিদা।
এশিয়ার "অর্থনৈতিক বিস্ময়", দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক মডেল যে দুর্বলতার বাইরে নয়, তার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে অনেক আগেই। সস্তা শ্রমের শোষণ, রপ্তানিকেন্দ্রিক অর্থনীতি, গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম'র ওপর অতি নির্ভরতা আর কর্পোরেট সংস্থাগুলোর পক্ষে সরকারি হস্তক্ষেপ- এই হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার মডেলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। উন্নয়নের হিসেব কষার অংকে এখনো তার অবস্থান অনেক উপরে। কিন্তু সমাজে আয় বৈষম্য বাড়ছে, শ্রমিকদের অধিকার কমছে এবং তরুণরা ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ হচ্ছে।