ল্যাটিন আমেরিকাঃ সংকটে ঘুরে দাঁড়ানোর দুই গল্প

Asad_USA
দুই সংকট নাড়া দিয়েছে ল্যাটিন আমেরিকারও দেশে দেশে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, বিশ্বের অন্য যে কোন অঞ্চলের তুলনায় এখানে সংকটের মেয়াদ ছিল স্বল্প মেয়াদী।

যদি প্রশ্ন করা হয়, এই মুহুর্তে ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি, নিঃসন্দেহে এর উত্তর হবে- সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য।

এই মহাদেশে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য যেমন আছে, প্রকট হয়ে আছে গ্রাম-শহরের বৈষম্য। গ্রামের মানুষ শহরের তুলনায় তিন গুণ বেশি দরিদ্র। মেক্সিকো সিটি, সান্তিয়াগো বা লিমার মতো বড় শহরের দরিদ্ররা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার কিছু সুযোগ পেলেও, প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ সেটা পায় না। সেখানে পানি ও বিদ্যুতের সংকটই প্রবল। দেশভেদে বৈষম্য আরও তীব্র। হাইতি'তে শহর অঞ্চলের দারিদ্র্যের হার চিলির তুলনায় ২৪ গুণ বেশি। গ্রামের হিসেবে এই পার্থক্য ৪৪ গুন!

এই বৈষম্যের চিত্র ল্যাটিন আমেরিকার ইউনিক কোন ব্যাপার না। এশিয়া, আফ্রিকা এমনকি ইউরোপেও বৈষম্য এরকমই বা এর চেয়েও বেশি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিশ্ব বাজারের মন্দা, যুদ্ধ- নানা কারণে একটা অস্থির যুগ পার করছে পৃথিবী। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব যখন অর্থনীতির ভূমিকম্পে কাঁপছে, তখন কি ছিল ল্যাটিন আমেরিকা অঞ্চলের ভূমিকা?

গত ১৫ বছরে দুটো ঘটনা সারা পৃথিবীর অর্থনীতিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। একটি হল- ২০০৮ এর মার্কিন অর্থনীতির বিপর্যয় আর দ্বিতীয়- ২০২০ এর কোভিড মহামারী। এই দুই সংকট নাড়া দিয়েছে ল্যাটিন আমেরিকারও দেশে দেশে।

কিন্তু অদ্ভুতভাবে, বিশ্বের অন্য যে কোন অঞ্চলের তুলনায় এখানে সংকটের মেয়াদ ছিল স্বল্প মেয়াদী।



২০০৮ এর সংকট

বিশ্বজোড়া জনপ্রিয় হওয়া Conditional Cash Transfer প্রোগ্রাম আসলে শুরু হয়েছিল ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে ব্রাজিল আর মেক্সিকো'তে।

ঘটনাক্রমে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি, ল্যাটিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশের স্বাধীনতা দিবস।

কিন্তু ২০০৮ এর মধ্য সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংবাদ ছাপিয়ে পত্রিকার হেডলাইন হয়ে যায়- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দেউলিয়াপনার খবর।

২০০০ এর শুরুর দিকেই লেহম্যান ব্রাদার্স নামের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ঝুঁকেছিল আবাসন ব্যবসার দিকে। বাড়ি কেনার জন্য ঋণ দিত যে সব ছোট প্রতিষ্ঠান, তাদের ঋণ দিত এই লেহম্যান ব্রাদার্স। ঐ বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ির চাহিদা পৌঁছে যায় চূড়ায়। ফলে একদিকে বেড়ে যায় ঝুকিপূর্ণ ঋণ, অন্যদিকে পাড়ে ঋণ নিয়ে প্রতারণা।

বহু মানুষ ঋণের কিস্তি শোধ করতে না পেরে হারিয়ে ফেলে বাড়ি। ব্যাংকগুলো দখল করা বাড়িগুলো বিক্রি করতে গিয়ে দেখে, চাহিদার তুলনায় বাজারে সরবরাহ হয়ে গেছে বেশি। ফলে বাড়ির দাম অনেক বছর পর কমে যায় মারাত্মক হারে; ফলাফল- পুরো অর্থনীতি ধাক্কা খেয়ে বসে পড়ে।

সরকারি 'বেইলআউট' পরিকল্পনার পরেও মার্কিন স্টক এক্সচেঞ্জের মূল্য এক তৃতীয়াংশ কমে যায়। শুধু লেহম্যান ব্রাদার্স নয়, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ এ নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে বহু ছোট ব্যাংক ও মর্টগেজ কোম্পানি।

এই সংকটের ঢেউ ল্যাটিন আমেরিকায় বড় করে লাগে ২০০৯ এ। বড় বড় মার্কিন বিনিয়োগকারীরা তাদের টাকা তুলে নিয়ে যেতে থাকে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো আর চিলি'র মত বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে টাকার মান কমে যায়, কমতে থাকে স্টক এক্সচেঞ্জের মান।

কিন্তু সেই ২০০৮ এই ল্যাটিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশ জনগণের জন্য একটা সেফটি নেট প্রোগ্রাম চালু করে ফেলে; নাম দেয়- শর্তযুক্ত নগদ সহযোগিতা (Conditional Cash Transfer- CCT)। পরবর্তীতে বিশ্বজোড়া জনপ্রিয় হওয়া এই প্রোগ্রাম আসলে শুরু হয়েছিল ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে ব্রাজিল আর মেক্সিকো'তে।

নির্দিষ্ট শর্ত মানলে এনলিস্টেড দরিদ্র পরিবারগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরকারি স্টাইপেন্ডের টাকা জমা হতো। দরিদ্রদের জন্য এ ছিল এক বিরাট স্বস্তির ব্যাপার। আর সাথে সাথে রাষ্ট্রও উপকৃত হল; কারণ, দারিদ্র্যের হার নেমে গেল উল্লেখযোগ্য হারে। ২০০১ সালে ল্যাটিন আমেরিকায় যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৪.১%, ২০১৪ তে সেটা নেমে দাঁড়াল ২৭.৮%।

এই সময়ে চরম দারিদ্রসীমার হারও ১২.২% থেকে নেমে ৭.৮৮% এ দাঁড়ায়। তবে গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, মেক্সিকো ও ভেনেজুয়েলায় চিত্র কিছুটা ভিন্ন ছিল; দারিদ্র্য সেখানে ঠিক এই হারে কমেনি।

CCT প্রোগ্রামের শর্ত দেশভেদে ভিন্ন ছিল, তবে বেশিরভাগই শর্তগুলো ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সাথে সম্পর্কিত। যেমন- ঐ পরিবারের শিশুদের স্কুলে ভর্তি ও উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক ছিল, গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাজিরা দিতে হতো। আবার অনেক দেশ এই প্রোগ্রামের শর্তগুলোকে জাতিসংঘের ২০০০ সালের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (MDGs) সঙ্গে যুক্ত করেছিল।

এই প্রোগ্রামের সফলতার বড় কারণ হিসেবে ধরা হয় এর নারীকেন্দ্রিক মডেল। শুধুমাত্র পরিবারের মায়ের হাতেই টাকা দেয়া হত। যুক্তিটা বোধগম্য। পরিবারের জন্য খরচে মায়েরা বেশি দায়িত্বশীল হয়। বাবা-দের তুলনায় তারা সন্তানের খাবার বা শিক্ষা উপকরণের পেছনে খরচ করতে বেশি মনযোগী হয়।



কোভিড ১৯ সংকট

এই সংকট এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি ল্যাটিন আমেরিকা।

২০ মার্চ ২০২০, পুরো পৃথিবীতে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করা হল কোভিড ১৯ কে।

সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেল, লক ডাউন চালু হল, খুব জরুরী ছাড়া প্রায় সব কাজ বন্ধ হয়ে গেল। ল্যাটিন আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের আক্রমণ তীব্র হল আগস্ট সেপ্টেম্বরের দিকে।

এপ্রিল ২০২১ এ টিকা দেয়া শুরুর পরে যখন বিশ্ব অর্থনীতি আবার চালু হতে শুরু করল, ল্যাটিন আমেরিকা হিসেব করে দেখল, প্যান্ডেমিকের কারণে দুনিয়াজোড়া মৃত্যুর ২৭% ই এই অঞ্চলে; মনে রাখা দরকার, বিশ্ব জনসংখ্যার ৮% কেবল থাকে ল্যাটিন আমেরিকায়।

এবং অনিবার্যভাবেই যারা মারা গেছে, বেশিরভাগই দরিদ্র শ্রেণীর। পেরু'র অবস্থা ছিল বিশেষভাবে খারাপ। ঝপ করে ল্যাটিন আমেরিকার জিডিপি নেমে গেল ৭% নিচে। গ্লোবাল এভারেজ থেকেও এই হার দ্বিগুণ বেশি। এহেন সংকট থেকেও ল্যাটিন আমেরিকা বেরিয়ে গেল ২ বছরের মাথায়। ২০২২ এর মধ্যেই দেশগুলোর প্রায় সব সূচক করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে ফিরে গেছে।

মহামারির সময় কিউবার মত দেশের স্থিতিশীল অবস্থা যেমন ভেঙ্গে পড়েছে, পাশাপাশি ল্যাটিন আমেরিকার 'অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির' দুর্বলতাও চোখে পড়েছে খুব বেশি করে। অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি শুধু ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনীতির অংশ নয়, এটি সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে গেছে। যখন আয় রোজগার কঠিন হয়ে যায়, তখন এই অঞ্চলের মানুষের অভ্যাসই হল বাড়তি আয়ের জন্য অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির দিকে ঝোঁকা। কেউ রাস্তায় দোকানদারি করে, কেউ নিজের বাইক বা গাড়ি ভাড়ায় খাটায়, কেউ বা রাস্তার কোণে ছোট ঝাঁপি নিয়ে বসে। জাতীয় অর্থনীতিতে এই অনানুষ্ঠানিক খাতের অবদান ল্যাটিন আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি বলিভিয়ায় (৬০%); সবচেয়ে কম চিলি'তে (২০%)। কোভিড ১৯ এসে এই বিশাল অবদানের খাতটা লণ্ডভণ্ড করে দিল।

খাদ্য, জ্বালানী, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম বাড়ল প্রায় ৩০% হারে।

এই সংকট এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি ল্যাটিন আমেরিকা। সরকারগুলো সামাজিক সহায়তা প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিয়েছে। অনেক দেশ অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ ও বিনিয়োগ নীতির মাধ্যমে কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছে। পর্যটন, কৃষি ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চাঙা করার চেষ্টা করা হয়েছে অর্থনীতিকে।

তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের চাপ এবং বৈশ্বিক সরবরাহ সংকটের কারণে পুরোপুরি স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে এখনো সময় লাগছে।



এই লেখাটি তৈরি করা হয়েছে Molly C. Ball এর লেখা Latin American Economic History: An Introduction to Daily Life, Debt, and Development বইয়ের সপ্তম অধ্যায়- Recent History (2008–2022) অবলম্বনে। মলি সি. বল ইউনিভার্সিটি অফ রোচেস্টারে ইতিহাস পড়ান এবং ল্যাটিন আমেরিকান স্টাডিজের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। [https://library.oapen.org/bitstream/handle/20.500.12657/93109/1/9781040149270.pdf]

পড়ে দেখতে পারেন