নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে কেন?

২০২৪ এ সরকারী যে জরিপ করা হল, তাতে দেখা গেল দেশের দেশের শ্রম শক্তি বা লেবার ফোর্সের সংখ্যা বেড়েছে। খুব ভাল কথা!
কিন্তু তারপরই জানা গেল, ২০২৩ এর তুলনায় আবার শ্রম শক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে। ২০২৩ এ শ্রম শক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ২৫.৩ মিলিয়ন আর ২০২৪ এ ২৪.৪৫ মিলিয়ন। মানে, প্রায় ৯ লক্ষের মত নারী আর শ্রমশক্তিতে নেই!
মনে রাখা দরকার, আইএলও এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, গত সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টা বেতন, মজুরি, লাভ যিনি তুলেছেন বা পরিবারের জন্য উৎপাদনমূলক কাজ করেছেন, তিনি কর্মসংস্থানের আওতাভুক্ত হিসেবে গণ্য হবেন।
তাহলে এত সংখ্যক নারী কাজের বাইরে গেল কেন?
একটা বড় কারণ, সম্ভবত, পোশাক খাত।
পোশাক খাতে নারী শ্রমিক হ্রাস

আসলে সস্তা শ্রম আর মেয়েদের জীবনের অনিশ্চয়তাকে কাজে লাগিয়ে রীতিমত শোষণ করেছে এই খাতের মালিকেরা
অনেকদিন থেকেই আমরা শুনে আসছি, পোশাক খাতে শতকরা ৮০ ভাগ শ্রমিকই নারী। তাদের হাতেই গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম এই সম্ভাবনা। আমরা শুনেছি অনেক পজিটিভ সংবাদ। অদক্ষ শ্রমের চাহিদা বিপুল সংখ্যায় নারী ও কিশোরীদের টেনে এনেছিল গ্রাম থেকে শহরে। বহু নারী নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন, জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। সেই সময় অনেকেই দেখিয়েছেন, এটা অতিকথন। আসলে সস্তা শ্রম আর মেয়েদের জীবনের অনিশ্চয়তাকে কাজে লাগিয়ে রীতিমত শোষণ করেছে এই খাতের মালিকেরা (The impact of paid employment on women's empowerment: A case study of female garment workers in Bangladesh/ Md Abdullah Al Mamun, Md Mahmudul Hoque; World Development Sustainability, Volume 1, 2022, 100026)। কিন্তু এখন আবার পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।
GIZ এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৫ সালের পর থেকে পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের হার কমে যাচ্ছে। ১৯৮০ সালে এই খাতে আসলেই শ্রমশক্তির ৮০%ই ছিল নারী। কিন্তু ২০১৫ সালে যেখানে নারী শ্রমিকদের শতকরা হার ছিল ৫৪.২২%, ২০১৮ সালে এই হার ৫৩.৮৯% আর ২০২১ সালে ৫৩.৬৫%-এ নেমে আসে।
কিন্তু কারণটা কি?
দুটো কারণ

এক দশক আগের তুলনায় এই খাতে কম প্রতিষ্ঠান সক্রিয় রয়েছে; তবে অন্যদিকে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে।
কেন এই হার কমেছে, তার একটা কারণ হতে পারে, সামগ্রিকভাবে পোশাক খাতেই বার্ষিক কর্মসংস্থানের বাড়ে খুব ধীরগতিতে। এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট (ACD)-এর এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ছিল বার্ষিক মাত্র ১.০৭%।
২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক (RMG) খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি খুব কম বা একেবারেই হয়নি। একই সময়ে, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (BGMEA)-এর সদস্যভুক্ত কারখানার সংখ্যা ২০১০-১১ সালের ৫,১৫০ থেকে ২০১৮-১৯ সালে ৪,৬২১-এ নেমে আসে। এতে বোঝা যায়- এক দশক আগের তুলনায় এই খাতে কম প্রতিষ্ঠান সক্রিয় রয়েছে; তবে অন্যদিকে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে।
দ্বিতীয় কারণ, প্রযুক্তি।
এমনিতেই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সব শাখায় নারীদের অংশগ্রহণ সমান নয় কখনই। যেমন, এমব্রয়ডারি শাখায় ৯৮.৯% ই পুরুষ কর্মী, ওয়াশিং এ ৮২.৮%, ডাইয়িং এ ৯৮%, কাটিং এ ৫৯%, নিটিং এ ৬৯%।
এনারী শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি মূলত সেলাই শাখায়- ৬৭.৪%। আর ফিনিশিং এ ৫৮% (সূত্রঃ Understanding the Gender Composition and Experience of Ready-Made Garment (RMG) Workers in Bangladesh, ILO, 2020)। শতকরা হারে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে কেবল ‘প্যাকেজিং ও প্রিন্টিং’ শাখায়; অন্যান্য সব শাখায় কমে গেছে।
আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি যখন থেকে ফ্যাক্টরিতে জায়গা করে নিতে শুরু করল, তখন দুটো জিনিস ঘটল। এক, শ্রমিকদের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দিল; আর দুই, যন্ত্র চালাতে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন পড়ল। পড়াশোনায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা নারীরা এই ক্ষেত্রে মার খেয়ে গেল।
আরেক দিক থেকে দেখা যায় ব্যপারটাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে কারখানাগুলোতে অস্থিরতা, বেশি টাকা উপার্জনের আশা ও স্বাধীন পেশার আকাঙ্ক্ষার কারণে পোশাক খাতের বিকল্প ভাবতে শুরু করেন তারা।
এখানে শ্রমিকরা মূলত ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত এখানে কাজ করেন। বয়স ৩৫ হওয়ার পর তারা ঝুঁকতে থাকেন বিকল্প পেশার দিকে । বিকল্প হিসেবে তারা কেউ যান কৃষিভিত্তিক ও গৃহস্থালী কাজে; কেউ কাজ করেন নিজস্ব সেলাইয়ের দোকানে।
কিন্তু এখন কথা হল, যে নারীরা গার্মেন্টস ছেড়ে দিচ্ছেন, তারা এরপর কি করছেন আসলে
অনেকই যে কিছুই করছেন না, সেটা অনুমান করা যায় জরিপের ফলাফল দেখে। তারা কিছু না কিছু করলে তো আর শ্রম শক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কমত না।